নিজস্ব প্রতিবেদক : চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের নবনির্বাচিত সভাপতি আগে ইসলামী ছাত্রসেনার নেতা ছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ২৭৮ সদস্যের এ পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘিরে রয়েছে আরো অভিযোগ। বিশাল এই কমিটিতে শিবিরকর্মী, ইয়াবা ব্যবসায়ী, বিবাহিত, হত্যা মামলার আসামি, গঠনতন্ত্রের বেশি বয়স স্থান পেয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। সবচেয়ে বড় অভিযোগ অনুমোদিত কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে। সভাপতি-সম্পাদক দু’জন আগে কখনো ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। বোয়ালখালীতে ছাত্রসেনার অর্থ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন বর্তমান সভাপতি এস এম বোরহান উদ্দিন। বুধবার (৪মার্চ) কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়।
অভিযোগে জানা যায়, কমিটিতে তালিকায় থাকা বহু সম্পাদকীয় ও শীর্ষ পদধারীরা বেশির ভাগই ইয়াবা ও মাদক কারবারে জড়িত। জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিসহ বিভিন্ন নাশকতা ও হত্যা মামলার আসামি বলেও জানা গেছে।
ছাত্রলীগ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কমিটির নেতাকর্মীদের বয়স হবে ২৯ বছর। এছাড়া যেকোনো জেলা কমিটি ঘোষণা করা হয় ১০১ সদস্যের। কিন্তু দক্ষিণে জেলা ছাত্রলীগের অনুমোদিত কমিটির সদস্য সংখ্যা ২৭৮ (প্রায়)। সহ সভাপতি পদে ৯জন রাখার নিয়ম থাকলেও ঘোষিত কমিটিতে রাখা হয়েছে ৬০ জনেরও বেশি।
যুগ্ম সাধারণ পদে পাঁচজন থাকার নিয়ম থাকলেও রাখা হয়েছে ১১ জনকে। সাংগঠনিক সম্পাদকে পাঁচজন রাখার নিয়ম থাকলেও রাখা হয়েছে ১১ জনকে।
ছাত্রলীগের একাধিক সূত্র ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, সদ্য অনুমোদিত কমিটিতে পদ পাওয়া সহ সভাপতি আব্দুল্লাহ আল মামুন বর্তমান সংসদ সদস্য মোছলেম উদ্দিন আহমেদের সরকারি এপিএস। সহ সভাপতি সাইদুর রহমান জিহান ত্রিশোর্ধ্ব। তিনি একটি গ্রুপ অব কোম্পানিতে দু’বছর ধরে চাকরি করছেন। সহ সভাপতি জয়নুল আবেদিন ফরহাদ ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে কর্মরত। সহ সভাপতি মোহাম্মদ মুসার বয়স ৩৫ এবং তার ছাত্রত্ব নেই। সহ সভাপতি মামুনে বাড়ি চন্দনাইশ এবং সে নারী নির্যাতন মামলার আসামি। সহ সভাপতি মো. খালেদ মাসুদের পুরো পরিবারের জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর রেজা ছাত্রসেনা থেকে চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি হয়েছেন।
এছাড়া অভিযোগ রয়েছে, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বদরুদ্দোজা জুয়েল জনি হত্যা মামলার আসামিদের সহযোগী এবং অন্য একটি মামলায় ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি। অপর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হক তুহিন বাঁশখালীতে জামায়াত-শিবিরের নাশকতা মামলার আসামির ছেলে এবং এক সময় সক্রিয় শিবিরের রাজনীতি করতেন। যুগ্ম সম্পাদক আরেকুর রহমান তিন মাস আগেও নারী কেলেঙ্কারির জন্য আনোয়ারা কলেজে হেনস্তা হয়েছেন।
এছাড়া সাংগঠনিক সম্পাদক কলিমুল্লাহ সাতকানিয়া কেরানিহাটে নাশকতা মামলার আসামি এবং শিবির ক্যাডার ছিলেন। সাংগঠনিক সম্পাদক হামিদ হোসাইন কোতোয়ালি থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদকের ছোট ভাই এবং স্থানীয় এমপি ও প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে কটূক্তি করায় দু’বছর আগে বাঁশখালী থানা পুলিশের হাতে আটক হয়েছিলেন। সহ সাংগঠনিক সম্পাদক তসলিম উল্লাহ চৌধুরী শিবিরের সাথী ছিলেন এবং বাঁশখালী শেখেরখীল ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত জামায়াত পরিবারের সন্তান। গ্রন্থনা ও প্রকাশনা উপ-সম্পাদক গাজী আমিনুর রশিদ ৩৮ বছর বয়সী, বিবাহিত এবং একজন অভিযুক্ত চাঁদাবাজ। সাংস্কৃতিক উপ-সম্পাদক মানিক অছাত্র এবং চাঁদাবাজ হিসেবে পরিচিত এলাকায়।
তৃণমূল নেতাকর্মীদের অভিযোগ, প্রকৃত ছাত্ররা অপ-রাজনীতি আর টাকার কাছে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে কমিটিতে অনেকের স্থান হয়নি।
দক্ষিণ জেলার অনেক ছাত্র নেতারা জানিয়েছেন, অপকর্মে জড়িতরা যদি কমিটিতে পদ বাগিয়ে নেয় তাহলে সংগঠনের নীতি-আদর্শ ধুলায় লুটিয়ে যাবে। টাকা দিয়ে নেতা নির্বাচিত হলে সেই টাকা তুলতে বাধ্য হয়েই চাঁদাবাজি কিংবা টেন্ডারবাজি করতে হয়। টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি বা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষ বা মারামারির ঘটনাও ঘটে। সংঘর্ষে দলীয় কর্মী মারা যাওয়ার ঘটনাও দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগে ঘটেছে।
ছাত্রলীগের সূত্র বলছে, টাকা দিয়ে কমিটিতে অনেকে নেতা হয়েছেন। কমিটি গঠনে বিপুল অঙ্কের টাকা লেনদেন হওয়া অনেকটা অঘোষিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। কারো সঙ্গে চুক্তি করে টাকা নেওয়া হয়, টাকা দিলে পদ জোটে আর না দিলে জোটে না।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো-দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার ক্ষেত্রে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমানসহ জেলার শীর্ষ নেতাদের কারো মতামত নেয়া হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে। এই ব্যাপারে কিছুই জানেন না বলে জানান দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান। তিনি কমিটি ঘোষণা পর জানান, দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের যে কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে তাতে আমাদের কোন মতামত নেওয়া হয়নি। বিশেষ করে আমি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক-অথচ আমি জানিনা এই কমিটির ব্যাপারে। কমিটি ঘোষণার পর আমাকে ছাত্রলীগের ছেলেরা যে তালিকাটা দেখিয়েছে তাতে অনেক ভালো ছাত্রনেতা যারা দীর্ঘদিন আমাদের সাথে রাজপথে আন্দোলন সংগ্রামে ছিল তাদের অনেকেই কমিটিতে স্থান পায়নি। জামাত শিবির, বিবাহিত, অছাত্র, ছাত্রলীগের বয়সোর্ধ, ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রীসহ অনেকই কমিটিতে স্থান পেয়েছে বলে আমি শুনেছি। আমি বিস্মিত হয়েছি। আমি বিষয়টি সাথে সাথে আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক কাদের ভাইকে ( বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক ও পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ) জানিয়েছি। দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান দলের দুঃসময়ের মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তিনি বর্তমান ছাত্রলীগে শিবির-অছাত্র-বিবাহিত-ব্যবসায়ী অনুপ্রবেশকারীদের নিয়ে বেশ শঙ্কিত।
এই ব্যাপারে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সর্বশেষ কমিটির আহবায়ক সালাউদ্দিন সাকিব জানান, খেয়ে না খেয়ে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগকে ১৮ বছর ছায়ায়-মায়ায় আঁকড়ে রেখেছিলাম। কেউ কোন প্রশ্ন তুলতে পারবেনা। আমার রেখে আসা ছাত্রলীগ আজকে জামাত-শিবির আর অনুপ্রবেশকারীদের ভারে মহীরুহে পরিণত হয়েছে। ২৭৬ সদস্যের কমিটি দেখে বড় কষ্ট পেয়েছি। বেশির ভাগই অনুপ্রবেশকারী। জামাত-শিবির ভর করেছে ছাত্রলীগে। নতুন কমিটি করার সময় জেলার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক আমার কাছ থেকে একটু মতামত পর্যন্ত নেয়নি। এটাতো একটা শিষ্টাচার। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ যারা করে-তারা তাদের আগ্রজদের কাছ থেকে পরামর্শ নেন। আমি যখন নেতৃত্ব দিয়েছি। পকেটে টাকা না থাকলে মাইলের পর মাইল হেঁটেছি। না খেয়ে থেকেছি। দলকে বিক্রি করিনি। জামাত-শিবিরকে দলের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিইনি
নতুন কমিটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের ১ নম্বর সহ সভাপতি মো. মিজানুর রহমান বলেন, এ কমিটিতে এমন অনেক নাম এসেছে যারা এক সময় শিবিরের ক্যাডার ছিল। অনেকে বিবাহিত, চাকরিজীবী অনেকে হত্যা মামলার আসামি। অনেকে আবার এসএসসিও পাশ করেনি। বিশাল অঙ্কের টাকার বাণিজ্যের মাধ্যমে এ ধরনের বিতর্কিতদের কমিটিতে ঠাঁই দিয়ে পুরো কমিটি বিতর্কিত করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বর্তমান সভাপতি এস এম বোরহান উদ্দিন আগে ইসলামী ছাত্রসেনার অর্থ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। বোরহান উদ্দিন কখনো ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন না বলেও দাবি তার।
তিনি আরো বলেন, সহ সম্পাদক মোস্তাক আহমদ বিবাহিত, সহ সভাপতি সোহরাব হোসেন চৌধুরী শুভ তৌকির হত্যা মামলার আসামি। যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জয়নাল আবেদীন কাফকোতে চাকরি করেন। উপ সম্পাদক মোহাম্মদ এনাম বনফুলে চাকরি করেন (পটিয়া)। সহ সভাপতি কে এম পারভেজ উদ্দীন এক সময়ের শিবিরের ক্যাডার (জামায়াতের সাবেক এমপি সামশুল ইসলামের খালাত ভাই)। সহ সভাপতি মো. মিনহাজুল আবেদীন রেয়াজউদ্দীন বাজার তামাকুমন্ডী লাইনে ডিওর নামক কাপড়ের দোকানদার। উপ-ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক এস এম সাইফুল্লাহ রাহাত ফোর এইচ গ্রুপের হিসাবরক্ষক। সহ সম্পাদক মো. রায়হান রেলের খালাসি পদে কর্মরত (পোস্টিং পটিয়া)।
তথ্যমতে, দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের তৎকালীন আহ্বায়ক আব্দুল মালেক জনির মৃত্যুর প্রায় পাঁচ বছর পর ২০১৭ সালের ১৪ অক্টোবর আংশিক কমিটি ঘোষণা করেছিল কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। তখন অনুমোদিত কমিটিতে এস.এম. বোরহান উদ্দিন সভাপতি ও আবু তাহের সাধারণ সম্পাদক নাম ঘোষণা করা হয়। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এস.এম.জাকির হোসেন ৫১ সদস্য বিশিষ্ট ওই কমিটির অনুমোদন দিয়েছিলেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য বলেন, ৬ মাস ধরে আমরা এই কমিটি আটকে রেখেছিলাম। কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এই কমিটি দিয়েছি। আমরা বিতর্কিত কাউকে নিয়ে ছাত্রলীগ করতে চাই না। এই কমিটিতে যদি বিতর্কিত ও অনুপ্রবেশকারী থাকে, তাহলে আমাদের জানান। তাদের বিরুদ্ধে আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব।
তবে সভাপতি এস.এম. বোরহান উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, আমি কখনো ইসলামী ছাত্রসেনার রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম না। আমি আওয়ামী লীগ পরিবারের সন্তান। আর কমিটিতে শিবির বা বিতর্কিত কেউ থাকলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।