কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করেছে। গতকাল শনিবার বিকেল সাড়ে ৫টায় রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত ছাত্র-জনতার উদ্দেশে এক দফা দাবিসহ ঘোষণাপত্র পাঠ করেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। এ সময় শহীদ মিনারে সামনের সারিতে আরো উপস্থিত ছিলেন আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও আবদুল কাদের। এর আগে তাঁরা ৯ দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন।
শহীদ মিনারের সমাবেশে রবিবার (৩ আগস্ট) থেকে সরকার পদত্যাগ না করা পর্যন্ত ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ আন্দোলন চলবে বলে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়।
তবে সরকারের পক্ষ থেকেও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সমঝোতার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। গতকাল সকালে পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের চলমান পরিস্থিতিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সমন্বয়কদের সঙ্গে বসার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘গণভবনের দরজা খোলা।
কোটা আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আমি বসতে চাই, তাদের কথা শুনতে চাই। আমি সংঘাত চাই না।’
কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কারীরা। গতকাল দুপুর সোয়া ২টার দিকে নাহিদ ইসলাম তাঁর ফেসবুক আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে বলেন, ‘খুনি সরকারের কাছে বিচার চাওয়া বা সংলাপে বসারও সুযোগ আর নেই।
ক্ষমা চাওয়ার সময়ও পার হয়ে গেছে। যখন সময় ছিল তখন সরকার ব্লক রেইড দিয়ে শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করেছে, নির্যাতন করেছে। আখতার হোসেন, আরিফ সোহেলসহ রাজবন্দিদের কারাগারে রেখে আমরা কোনো ধরনের সমঝোতায় যাব না।’
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে আলোচনায় বসার জন্য আওয়ামী লীগের ৩ নেতা দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও মাহবুবউল আলম হানিফকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আলোচনায় থাকতে ১৪ দলীয় নেতাদের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সমাবেশে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘বর্তমান সরকারের নির্দেশে নির্বিচারে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। নারী, শিশু, ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক—কেউ এই হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পাননি। এই হত্যাকাণ্ডের বিচারের পরিবর্তে ছাত্র-জনতাকে নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করা হয়েছে। সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এই হত্যাযজ্ঞে মারণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেছে। ফলে এই সকারের অধীনে নিরপেক্ষ বিচার ও তদন্ত সম্ভব নয়। আমরা এই স্বৈরাচারী সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করছি।’
দেশে গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়েছে জানিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা সবার সঙ্গে আলোচনা করে সম্মিলিত মোর্চা গঠন করব। এরপর এর রূপরেখা ঘোষণা করব। রবিবার (আজ) থেকে সর্বত্র অসহযোগ আন্দোলন চলবে।’
এই আন্দোলনে সবাইকে যোগ দেওয়ার আহবান জানান তাঁরা। সেনাবাহিনীসহ নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর উদ্দেশে নাহিদ বলেন, ‘জনগণ এই সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আপনারা সরকারকে সমর্থন না দিয়ে জনগণকে সমর্থন দিন।’
ছাত্র-জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘বাংলার জনগণ শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন করবে, নেতৃত্ব দেবে। যদি কারফিউ জারি হয়, ইন্টারনেটসেবা বন্ধ হয়, তখন সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়ালে জনগণ তা মানবে না। আপনারা যদি অস্ত্র চালান, তাহলে প্রতিরোধ করা হবে। সব গণহত্যার বিচার করব বাংলার মাটিতে।’
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের বিক্ষোভ সমাবেশে অংশ নিতে গতকাল দুপুর থেকে জড়ো হতে শুরু করেন শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে দুপুর দেড়টা থেকে বৃষ্টি উপেক্ষা করে শহীদ মিনারে জড়ো হতে থাকেন তাঁরা। এ সময় জনসমুদ্রে পরিণত হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।
বিকেল ৩টায় কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও পুরো এলাকায় মানুষের ঢল নামে। এ সময় তারা ‘শিক্ষার্থীদের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’, ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, ‘আমার ভাই মরল কেন, জবাব চাই’, ‘জেগেছে রে জেগেছে, ছাত্রসমাজ জেগেছে’ এসব স্লোগান দেয়।
বিকেল সাড়ে ৩টায় সমাবেশস্থলে এসে উপস্থিত হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা। শহীদ মিনারের মূল বেদিতে দাঁড়িয়ে নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলমসহ অন্য সমন্বয়কদের স্লোগান দিতে দেখা যায়। একই সময় সায়েন্স ল্যাব থেকে একটি এবং ধানমণ্ডি থেকে শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীদের একটি বড় মিছিল এসে পৌঁছে। মানুষের ঢল শহীদ মিনার এলাকা ছাপিয়ে চানখাঁরপুল মোড়, দোয়েল চত্বর, জগন্নাথ হল মোড় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল টাওয়ার পর্যন্ত ছাড়িয়ে যায়।
তবে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কর্মসূচি ঘোষণার পর হাজারো ছাত্র-জনতা শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয়। গতকাল রাত সাড়ে ৮টায় শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তারা শাহবাগসহ আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছিল।
এর আগে সকাল থেকে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, সায়েন্স ল্যাব, শান্তিনগর, মিরপুর-১০, বাড্ডা, আফতাবনগর, রামপুরা, প্রগতি সরণি, উত্তরাসহ বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনে অবস্থান নেয়। এরপর পুরো ঢাকা শহর থেকে দলে দলে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারে যোগ দিয়েছেন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের উত্তরসূরির ব্যানারে বীর মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ মিনারে সমবেত হন। শহীদ মিনারে সংহতি জানান সংস্কৃতিকর্মীরাও।
শুধু রাজধানীই নয়, গতকাল সারা দেশেই বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ। রাজধানীতে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে। অনেকে এতে হতাহত হয়েছে বলে জানা যায়। অনেক জায়গায় সড়ক অবরোধ, আগুন দেওয়াসহ ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। গাজীপুরের শ্রীপুরে ৬৫ বছর বয়সী একজনের মৃত্যু হয়। কুমিল্লা, সিলেট, বগুড়া, ফরিদপুর, জামালপুরসহ বেশ কিছু স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
অসহযোগ সফল করতে ১৫ নির্দেশনা
১।কেউ কোনো ধরনের ট্যাক্স বা খাজনা প্রদান করবেন না।
২। বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, পানির বিলসহ কোন ধরনের বিল পরিশোধ করবেন না।
৩। সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, অফিস আদালত ও কল-কারখানা বন্ধ থাকবে। আপনারা কেউ অফিসে যাবেন না, মাস শেষে বেতন তুলবেন।
৪। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
৫। প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে কোনো ধরনের রেমিট্যান্স দেশে পাঠাবেন না।
৬। সব ধরনের সরকারি সভা, সেমিনার, আয়োজন বর্জন করবেন।
৭। বন্দরের কর্মীরা কাজে যোগ দেবেন না। কোনো ধরনের পণ্য খালাস করবেন না।
৮। দেশের কোনো কলকারখানা চলবে না, গার্মেন্টসকর্মী ভাই-বোনেরা কাজে যাবেন না।
৯। গণপরিবহন বন্ধ থাকবে, শ্রমিকরা কেউ কাজে যাবেন না।
১০। জরুরি ব্যক্তিগত লেনদেনের জন্য প্রতি সপ্তাহের রোববার ব্যাংকগুলো খোলা থাকবে।
১১। পুলিশ সদস্যরা রুটিন ডিউটি ব্যতীত কোন ধরনের প্রটোকল ডিউটি, রায়ট ডিউটি ও প্রটেস্ট ডিউটিতে যাবেন না। শুধুমাত্র থানা পুলিশ নিয়মিত থানার রুটিন ওয়ার্ক করবে।
১২। দেশ থেকে যেন একটি টাকাও পাচার না হয়, সকল অফশোর ট্রানজেকশন বন্ধ থাকবে।
১৩। বিজিবি ও নৌবাহিনী ব্যতীত অন্যান্য বাহিনী ক্যান্টনমেন্টের বাইরে ডিউটি পালন করবেন না। বিজিবি ও নৌবাহিনী ব্যারাক ও কোস্টাল এলাকায় থাকবে।
১৪। আমলারা সচিবালয়ে যাবেন না, ডিসি বা উপজেলা কর্মকর্তারা নিজ নিজ কার্যালয়ে যাবেন না।
১৫। বিলাস দ্রব্যের দোকান, শো-রুম, বিপণী-বিতান, হোটেল, মোটেল, রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকবে।
তবে হাসপাতাল, ফার্মেসি, জরুরি পরিবহণ সেবা যেমন-ঔষধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম পরিবহণ, অ্যাম্বুলেন্স সেবা, ফায়ার সার্ভিস, গণমাধ্যম, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য পরিবহণ, জরুরি ইন্টারনেট সেবা, জরুরি ত্রাণ সহায়তা এবং এই খাতে কর্তব্যরত কর্মকর্তা-কর্মচারী পরিবহণ সেবা চালু থাকবে।
এছাড়াও, নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকানপাট বেলা ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।