মঙ্গলবার, ১১ই ফেব্রুয়ারি ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

মঙ্গলবার, ১১ই ফেব্রুয়ারি ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ মঙ্গলবার, ১১ই ফেব্রুয়ারি ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৮শে মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১১ই শাবান ১৪৪৬ হিজরি

ঘুষের বিনিময়েও মনোনয়ন না পেয়ে ক্ষুদ্ধ জাপা নেতারা, মহাসচিবকে প্রকাশ্যে আল্টিমেটাম

প্রভাতী ডেস্ক: এইবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভয়াবহ মনোনয়ন বাণিজ্যের কবলে পড়ে জাতীয় পার্টি অনেকটা বিপর্যস্ত। বাধ্য হয়ে যারা বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়েও শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন নিশ্চিত করতে পারেননি তাদের ক্ষোভ-অসন্তোষ এখন চরমে। টাকা ফেরত দেয়ার জন্য ভুক্তভোগীরা পার্টির মহাসচিব রুহুল আমিনকে প্রকাশ্যে আলটিমেটাম দিয়েছেন। সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, দ্রুত টাকা ফেরত না দিলে পুলিশও তাকে রক্ষা করতে পারবে না। মঙ্গলবার দিনভর এ রকম ক্ষোভ-প্রতিবাদের ঘটনা ঘটে বনানীর দলের কার্যালয়ে।

অভিযোগ উঠেছে, আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন নিশ্চিত করার কথা বলে জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার দলের মাঠ মনোনয়ন প্রত্যাশীদের অনেকের কাছ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন, যা ফেরত পেতে তারা মহাসচিবকে হন্য হয়ে খুঁজছেন। রুহুল আমিন হাওলাদারের গুলশানের বাসায়, তার তেজগাঁওয়ের ব্যবসায়িক কার্যালয়, এমনকি বনানীর পার্টি চেয়ারম্যানের কার্যালয়- সর্বত্র হানা দিচ্ছেন বিক্ষুব্ধরা।

পাওনাদার নেতাদের কয়েকজন বলেন, কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না তাকে। টাকা ফেরত দেয়ার ভয়ে তিনি এক রকম আত্মগোপনে থাকছেন। মাঝে মধ্যে প্রকাশ্যে এলেও নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনীকে তাকে ঘিরে ধরে সার্বক্ষণিক পাহারায় রাখছেন। যে কারণে পাওনাদার নেতারা দেখা করতে পারছেন না।

ভুক্তভোগীদের একজন নীলফামারী-৪ আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য শওকত চৌধুরী। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে ভোট ছাড়াই এমপি হন তিনি। এবারও তাকে মনোনয়ন দেয়ার কথা বলে ১ কোটি টাকা নেন এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার।

পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নাম করে তার কাছ থেকে এই টাকা নেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত শওকত চৌধুরীকে মনোনয়ন না দিয়ে এ আসনে মনোনয়ন দেয়া হয় দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য জিয়াউদ্দিন আহম্মেদ বাবলুকে। যিনি চট্টগ্রামের মানুষ, চট্টগ্রামের একটি আসন থেকে বিনা ভোটে জাতীয় পার্টির এমপি হন। বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়েও মনোনয়ন না পেয়ে মঙ্গলবার শওকত চৌধুরী বনানীর এরশাদের অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে হুমকি দিয়ে বলেন, ‘আমার টাকা ফেরত দিয়ে স্যারকে (এরশাদ) এবং হাওলাদারকে সৈয়দপুর যেতে বলবেন। না হলে পুলিশও তাদের রক্ষা করতে পারবে না, বলে গেলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি তাকে দেখে নেব। ষাট লাখ টাকা দিয়েছি। যখন যা চেয়েছে সব দিয়েছি, কোন অনুষ্ঠানে টাকা দেইনি? যখন সৈয়দপুর গেছেন ওনার জন্য কী করিনি? তাই আমার টাকা ফেরত দিতে বলবেন। না দিলে খবর আছে।’ এ সময় সেখানে বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মী ছাড়াও বেশ কয়েকজন সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী কাজী মামুনুর রশীদ বলেন, ‘আমাদের মনোনয়ন যদি দেয়া না হবে, তাহলে কেন এত টাকা নিল? এত টাকাই বা খরচ করানো কেন হলো।’ তিনি এ সময় টাকা ফেরত দাবি করেন।

জয়পুরহাট-২ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী জাতীয় ছাত্র সমাজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম রিপন বলেন, ‘আমি নির্বাচনের জন্য প্রায় কোটি টাকার মতো খরচ করেছি। নেতারা মনোনয়ন দেয়ার কথা বলে টাকা নিয়েছেন।’

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ আসনের মনোনয়ন প্রত্যাশী ক্রীড়া সংগঠক জামাল রানা বলেন, মহাসচিব ১ কোটি টাকা চেয়েছেন। দিতে পারিনি তাই মনোনয়ন দেননি। তিনি আরও বলেন, এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার এবারের নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়ার নামে কোটি কোটি টাকা বাণিজ্য করেছেন। সবার আগে নিজের এবং স্ত্রী নাসরিন জাহান রত্নার মনোনয়ন নিশ্চিত করেছেন। এরপর যারা মোটা অংকের টাকা দিয়েছে তাদের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। যারা টাকা দেননি তারা জনপ্রিয় হলেও মনোনয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।

এদিকে এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে মনোনয়ন বাণিজ্যের অভিযোগ তুলে দল ছাড়তে শুরু করেছেন দলটির তৃণমূলের নেতারা। ফেনী জেলা জাতীয় পার্টির সভাপতি ও পার্টি চেয়ারম্যানের যুববিষয়ক উপদেষ্টা রিন্টু আনোয়ার ইতিমধ্যে এ অভিযোগ এনে দল থেকে পদত্যাগ করেছেন। লালমনিরহাট-২ (আদিতমারী-কালীগঞ্জ) আসন থেকে মনোনয়ন না পাওয়ায় জাতীয় পার্টি ছেড়ে মঙ্গলবার বিএনপিতে যোগ দিয়েছেন দলটির কেন্দ্রীয় সমাজকল্যাণ বিষয়ক যুগ্ম সম্পাদক ও লালমনিরহাট জেলা শাখার সদস্য সচিব রোকনউদ্দিন বাবুল। লালমনিরহাট জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক হাফিজুর রহমান বাবলা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের মনোনয়ন বাণিজ্যের বিরুদ্ধে ক্ষোভ তৃণমূল পর্যায়েও প্রকাশ্য রূপ নিতে শুরু করেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ (সরাইল ও আশুগঞ্জ) আসনে এবার মনোনয়ন দেয়া হয় অ্যাডভোকেট রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়াকে। তিনি পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের উপদেষ্টা। অথচ তার শ্বশুর অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা এ আসন থেকে জাতীয় পার্টির হয়ে পরপর দু’বার এমপি নির্বাচিত হন। জিয়াউল হক মৃধা অভিযোগ করেন, মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে পার্টির মহাসচিব তাকে বঞ্চিত করে তার জামাতা রেজাউল ইসলামকে মনোনয়ন দেয়। অথচ রেজাউলের এলাকায় কোনো পরিচিতি নেই, নেই জন ভিত্তিও।

জানা গেছে, রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়াকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে- এ খবরে জিয়াউল হক মৃধার সমর্থকরা মঙ্গলবার ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন। বেলা সোয়া ১১টায় সরাইল উপজেলার কুট্টাপাড়া মোড়ে এ কর্মসূচি পালিত হয়। এর ফলে মহাসড়কের দুই পাশে কয়েক কিলোমিটার তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। পুলিশ মহাসড়ক থেকে বিক্ষোভকারীদের সরানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। এরপর জিয়াউল হক মৃধা এসে বিক্ষোভকারীদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। এ সময় বিক্ষোভকারীরা জোরালোভাবে দাবি জানিয়ে বলেন, মহাজোট থেকে রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়ার বদলে যেন সংসদ সদস্য জিয়াউল হক মৃধাকে মনোনয়ন দেয়া হয়। অন্যথায় সরাইল-আশুগঞ্জে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।

পুলিশ পাহারায় পটুয়াখালীতে রুহুল আমিন : এদিকে মঙ্গলবার পুলিশ পাহারায় হেলিকপ্টারে করে পটুয়াখালী আসেন জাপা মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার। এদিন আওয়ামী লীগ ও মহিলা লীগের নেতাকর্মীরা দফায় দফায় রুহুল আমিন হাওলাদারের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে শহরের কয়েকটি পয়েন্টে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবেক ধর্ম প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শাহজাহান মিয়ার বাসার সামনে জাপা মহাসচিবের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে দেখা গেছে- ‘বাকেরগঞ্জের রুহুল আমিন, বাকেরগঞ্জে চলে যা।’

এছাড়া বিক্ষুব্ধ একাধিক এলাকাবাসী জানান, রুহুল আমিন হাওলাদার প্রার্থী হয়ে হেলিকপ্টার ব্যবহার করতে পারেন না। এটা স্পষ্ট আচরণবিধি লঙ্ঘন। নির্বাচন কমিশনের কাছে তাদের দাবি- এ বিষয়ে তদন্ত করে হাওলাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক। জেলা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা যুগান্তরকে বলেন, এবারও যদি এখানে রুহুল আমিনকে মনোনয়ন দেয়া হয় তাহলে এ আসনটি থেকে আওয়ামী লীগের নাম চিরতরে মুছে যেতে পারে। আসনটি বিএনপির দখলে চলে যেতে পারেও বলে মন্তব্য করেন তারা। এ প্রসঙ্গে রুহুল আমিন বলেন, আমি কখনো মানুষকে কষ্ট দিয়ে কোনো কাজ করিনি। আজ পটুয়াখালীতে মনোনয়ন দাখিল করতে আসিনি। আমি মায়ের কবর জিয়ারত করতে এসেছি।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Telegram
WhatsApp
Email
Print