
প্রভাতী ডেস্ক : বঙ্গোপসাগরে উপকূলীয় অঞ্চলের ৬৪তম ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে তছনছ হয়ে গেছে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলসহ দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের অনেক জেলা। প্রবল ঝড়ের তান্ডবে ২৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। ঝড়, জলোচ্ছাস ও অতিবৃষ্টিতে ভেঙে গেছে লাখ লাখ ঘরবাড়ি ও গাছপালা। উপড়ে পড়েছে বিদ্যুতের খুঁটি, ভেসে গেছে মৎস্য এবং চিংড়ি ঘের। অনেক জেলায় বিদ্যুৎ সরবাহ বন্ধ রয়েছে। এছাড়া আম, বোরো ধান সবজিসহ অন্যান্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এদিকে প্রায় ৪৮ ঘণ্টা পর সচলের পথে চট্টগ্রাম বন্দর।
ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির সঠিক পরিমাণ এখনো নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে ক্ষতির পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। এর মধ্যে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ এবং সাতক্ষীরা এলাকায় শুধু আমের খাতে আনুমানিক দুই হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে চাষিরা ধারণা করছেন। খুলনায় ভেসে গেছে ৫০ হাজার এবং বাগেরহাট জেলায় ৪ হাজার ৬৩৫টি চিংড়ি ঘের। এতে কমপক্ষে পাঁচ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হবে বলে মনে করছেন চিংড়ি চাষিরা।
আম্পানের আঘাতে বিভিন্ন জেলায় ২৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে যশোরে গাছ চাপা পড়ে মা মেয়েসহ ৮ নিহত হয়েছেন। পটুয়াখালীতে ঝড়ে গাছ চাপা পড়ে ও মানুষকে সচেতন করতে গিয়ে নৌকাডুবিতে ২জন মারা গেছেন। ভোলায় গাছচাপা পড়ে ও ট্রলারডুবে ২ জন মারা গেছেন। পিরোজপুরের মঠবাড়িয়াতে শাহজাহান মোল্লা নামে ৫৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তি মারা গেছেন দেয়ালে চাপা পড়ে। একই উপজেলার আমরাগাছী এলাকায় ৭০ বছর বয়সী গুলেনুর বেগম ও ইন্দুরকানীর উমিদপুরে ৫০ বছর বয়সী শাহ আলম ঝড়ের তান্ডবের সময় স্ট্রোক করে মারা গেছেন। এছাড়া সাতক্ষীরা সদরে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। বগুড়ায় বিদ্যুৎস্পৃশ্য হয়ে মারা গেছেন ২জন । এছাড়া চাঁদপুর, সিরাজগঞ্জ, বরগুনা, চট্টগ্রাম, ঝিনাইদহ ও রাজশাহীতে ১জন করে মারা গেছেন।
বুধবার সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি ও ঝড়ে রাজশাহী, বগুড়া, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা এসব এলাকার বোরো ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া গাইবান্ধা, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, পাবনায়ও কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝড় ও অতি বৃষ্টির কারণে পটল, ঝিঙে, চিচিঙ্গা, কাঁকরোলসহ বিভিন্ন তরকারির গাছ ঝড়ে ছিঁড়ে গেছে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে রাজশাহী ছাড়াও নওগাঁ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জে আমের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গাছ থেকে পড়ে গেছে বেশিরভাগ আম। রাজশাহীতে প্রায় ২০ ভাগ আম ঝড়ে গেছে। চাষিরা বলছেন এতে আনুমানিক দেড় থেকে দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। আম্পানে ভেসে গেছে বাগেরহাটের সাড়ে ৪ হাজার চিংড়ি ঘের। আম্পানের প্রভাবে বাগেরহাটে ৭-৮ ফুটের জলোচ্ছাসে বাগেরহাটের শরণখোলা উপজেলার শরণখোলা গ্রামের ৩৫/৩ পোল্ডারের ২শ’ মিটার রিংবাঁধ ভেঙে গেছে। ভেসে গেছে জেলার ৪ হাজার ৬৩৫টি চিংড়ি ঘের।
চট্টগ্রাম : ঘূর্ণিঝড়ের শক্তির তুলনায় ঝড়-তাড়িত জলোচ্ছাসেই সর্বাপেক্ষা বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যার বিস্তৃতি ঘটেছে চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগের উপকূল অবধি। চর উপকূল-দ্বীপাঞ্চলে বেড়িবাঁধ প্রায়ই বিধ্বস্ত এমনকি চিহ্নও নেই। অবশিষ্ট জরাজীর্ণ বেড়িবাঁধ প্রবল জোয়ার তথা জলোচ্ছাসের তোড়ে ভেঙে গিয়ে শতাধিক গ্রাম পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ফল-ফসল, মৎস্যঘের, গ্রামীণ অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতির ভয়াবহ চিত্র আসছে। অনেক জনপদ প্লাবিত থাকায় ঝুঁকি এড়াতে বিদ্যুৎ সঞ্চালন বন্ধ রেখেছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
ঘূর্ণিঝড় রাতভর ধ্বংসলীলা চালিয়ে দুর্বল স্থল নিম্নচাপ কেটে যাচ্ছে ভারতের দিকে। এটি ঘণ্টায় ১৫১ কি.মি. গতিতে আঘাত হানে সাতক্ষীরা জেলায়। যা বাংলাদেশে সর্বোচ্চ গতিবেগ। তারপর সারারাত ক্রমান্বয়ে খুলনায় এসে যশোর-নড়াইল-মাগুরা- রাজবাড়ী হয়ে পাবনায় পৌঁছায়। মূল ঘূর্ণিঝড়ের একাংশ আঘাত হানে রাজশাহীতে। এক পর্যায়ে আরো দুর্বল হয়ে বৃহস্পতিবার ভোরে স্থল নিম্নচাপ আকারে উত্তর-পূর্ব দিকে জামালপুর, ময়মনসিংহ হয়ে মেঘালয় দিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের দিকে কেটে যাচ্ছে।
বঙ্গোপসাগরে অবস্থানকালে এক পর্যায়ে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২৪৫ কিলোমিটার গতি পেয়ে ‘সুপার সাইক্লোনে’ পরিণত হলে বিভিন্ন মিডিয়া এটি সিডরের সমান এমনকি ততোধিক শত্তিতে বাংলাদেশে আঘাতের আভাস দেয়। বাস্তবে আঘাতের আগে সর্বোচ্চ গতি ছিল ১৮০ কি.মি.। ‘আম্পান’ স্থল গভীর নিম্নচাপে পরিণত হওয়ায় গতকাল মহাবিপদ সঙ্কেত নামিয়ে সমুদ্রবন্দরে ৩ নম্বর সতর্কতা দেখানো হয়। এদিকে, চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে জোয়ারের পানিতে ডুবে মো. সালাউদ্দিন (১৮) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। গতক বুধবার পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডে এই দুর্ঘটনা ঘটে।
সচল চট্টগ্রাম বন্দর : আম্পান দুর্বল হওয়ায় ও মহাবিপদ সঙ্কেত প্রত্যাহারের ফলে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম গতকাল সকাল থেকেই স্বাভাবিক কার্যক্রম সচল করতে শুরু করে। আইএসপিএস কোড অনুযায়ী বন্দর কর্তৃপক্ষও নিজস্ব সতর্কতা তুলে নেয়। ৪৮ ঘণ্টা পর আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী জাহাজের আসা-যাওয়া, জেটি-বার্থে ভিড়ানো, কন্টেইনার হ্যান্ডলিং, খালাস, ডেলিভারি পরিবহন কার্যক্রম সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত প্রায় স্বাভাবিক হয়ে আসে।
যশোর : সুপার সাইক্লোন আম্পান যশোর সাতক্ষীরা খুলনা ও ঝিনাইদহসহ দক্ষিণ পশ্চিমে রেখে গেছে ধ্বংসের চিহ্ন। ঘর বাড়ি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গাছপালা ভেঙে চুরে, মাঠের ফসল দলিত মথিত করে বিরাট ক্ষতি করেছে। আম্পানের তান্ডবে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপনের কাজ চলছে। বিদ্যুৎ সরবরাহ রাত থেকে যশোরসহ অনেক স্থানে বন্ধ রয়েছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক পার্থ প্রতিম সাহা জানান, ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের কাজ চলছে একটু সময় লাগবে। যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মাগুরা, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর জেলা এলাকায় প্রচুর আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, কলা গাছের ক্ষতি হয়েছে। উপড়ে গেছে রাস্তার পাশের গাছ। সূত্র জানায়, যশোরসহ ৬ জেলার ১লাখ ৫৩ হাজার ৭২১ হেক্টর শস্য ফসল মাঠের উপর দিয়ে আম্পানের তান্ডব চলেছে।
এদিকে, যশোরে আম্ফান তান্ডবে শার্শা, চৌগাছা ও বাঘারপাড়ায় গাছ চাপা পড়ে ৮ জন নিহত হয়েছেন। গাছচাপা পড়ে চৌগাছা পৌরসভার হুদো চৌগাছা এলাকার ওয়াজেদ হোসেনের স্ত্রী চায়না বেগম (৪৫) ও মেয়ে রাবেয়া খাতুন (১৩) নিহত হন বুধবার রাতে। এছাড়া গাছচাপা পড়ে শার্শা উপজেলার মালোপাড়ার সুশীল বিশ্বাসের ছেলে গোপাল চন্দ্র বিশ্বাস (২৮), গোগা পশ্চিমপাড়ার শাহজাহানের স্ত্রী ময়না খাতুন (৪০) ও বাগআঁচড়া জামতলা এলাকার আব্দুল গফুর পলাশের ছেলে মুক্তার আলী (৬৫) এবং বাঘারপাড়া উপজেলার দরাজহাট বুদোপাড়া এলাকার সাত্তার মোল্লার স্ত্রী ডলি খাতুন (৪৫) নিহত হন। এছাড়া মণিরামপুরে স্বামী-স্ত্রীর নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। তবে তাদের নাম পরিচয় জানা যায়নি।
রাজশাহী : রাজশাহীর মোহনপুরে আম্পানের ঝড়ের মধ্যে আম কুড়াতে গিয়ে মনোয়ারা বেগম (৪২) নামে এক নারী নিহত হয়েছে। সে উপজেলার হরিদাগাছি গ্রামের বারুইপাড়ার ইসহাক আলীর স্ত্রী।
খুলনা : ঝড়ের আঘাতে খুলনা সাতক্ষীরা বাগেরহাটসহ উপক‚লীয় এলাকাজুড়ে লন্ডবন্ড হয়েছে কয়েক লক্ষাধিক ঘরবাড়ি। ফলে এ অঞ্চলের অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের ঠাঁই হয়েছে খোলা আকাশের নিচে। এদিকে ভারী বর্ষণ ও জোয়ারের পানি বৃদ্ধিতে বেড়িবাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে অর্ধ লক্ষাধিক মাছের ঘের ও পুকুর। বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে এক ঘণ্টার মধ্যেই উপকূলীয় এলাকার ৫১ লাখের মতো গ্রাহক বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আম্পানের প্রভাবে বুধবার রাতে সাতক্ষীরা, খুলনাসহ পশ্চিম উপক‚লে ৫ থেকে ৭ ফুট উঁচু জলোচ্ছাস বয়ে যায়। রাত ১০টার দিকে জোয়ার শুরু হলে ১৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু জলোচ্ছাস হয়।
ঝালকাঠি : সুগন্ধা ও বিষখালী নদীতে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় জেলার চার উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ৫০ গ্রামের বাসিন্দা। জেলার কাঁঠালিয়া উপজেলায় বেড়িবাঁধ ভেঙে ফসলের ক্ষেত ও বসতঘর তলিয়ে গেছে।
ভোলা : ভোলার মনপুরায় ঘূর্ণিঝড় আম্পানের তান্ডবে ৮ কিলোমিটার বেড়িবাঁধসহ ১৩ কিলোমিটার মাটির রাস্তা বিধ্বস্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। উপজেলার চারটি ইউনিয়নে ৩৫১টি বসত-ঘরের আংশিক ক্ষতিসহ ১টি ঘর ও একটি হাফেজিয়া মাদরাসার টিনের ঘর সম্পূর্ণ ক্ষতি হয়। বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে ৫০ হেক্টর সবজি ক্ষেতের ক্ষতিসহ ১৭৭ টি পুকুর ও ১ টি চিংড়ি ঘেরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে।
পটুয়াখালী : পটুয়াখালী জেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে জেলার ৭৩ টি ইউনিয়নে পাঁচটি পৌরসভায় ১০হাজার ৪৭৬টি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মাছের পুকুর ও ঘের ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে নদীও সাগরের পানি স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫ থেকে ৭ফুট বৃদ্ধি পাওয়ায় তলিয়ে গিয়ে মাছ ভেসে যায়।
বরগুনা : আম্পানের তান্ডবে বরগুনায় নয় হাজার আটশ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জলোচ্ছাসে বিলীন হয়ে গেছে সাড়ে ১৩ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ। ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের তাÐবে জেলার ছয়টি উপজেলায় ৪২টি ইউনিয়ন ও চারটি পৌরসভায় নয় হাজার আটশ ঘরবাড়ি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বরগুনা জেলার সদর উপজেলার বালিয়াতলিতে কাজী শহীদ নামে ৬৩ বছর বয়সী একজন মারা গেছেন গাছচাপায়।
বগুড়া : ঘুর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে গত বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত বগুড়ায় অব্যাহত বর্ষণের পাশাপাশি ঝড়ে ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিদ্যুতায়িত হয়ে মারা গেছেন ২ জন।
সিরাজগঞ্জ : সিরাজগঞ্জে সুপার সাইক্লোন আম্পানের প্রভাবে ঝড়ে হাওয়ায় গাছচাপায় দেলসাত আলী (৩৮) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন।
চাঁদপুর: চাঁদপুরে ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময় আম কুড়াতে গিয়ে গাছচাপা পড়ে জান্নাত বেগম (৩৫) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে।
ঝিনাইদহ : প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে ঝিনাইদহে ঘরের উপর গাছ ভেঙে পড়ে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। সদর উপজেলায় হলিধানী গ্রামে বুধবার গভীর রাতে এ ঘটনা ঘটে।