প্রভাতী ডেস্ক : রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় রাজধানীর জুরাইনে মায়ের কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন অবিভক্ত ঢাকার সর্বশেষ মেয়র, বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান, সাবেক মন্ত্রী ও ঢাকা মহানগরের সাবেক সভাপতি সাদেক হোসেন খোকা। তাঁর নামাজে জানাযায় জনতার ঢল নেমেছিল।
আজ বৃহস্পতিবার (৭নভেম্বর) সকাল ৮টায় ২৬ মিনিটে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায় বিএনপির এই অন্যতম প্রভাবশালী নেতার লাশবাহী ফ্লাইট। বিমানবন্দরে খোকার মরদেহ গ্রহণ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু।
সকাল ১০ টায় সংসদ ভবনে ২য় নামাজে জানাজা শেষে দুপুর ১২-১টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নানা শ্রেণি পেশার মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের পর দুপুরে তার মরদেহ নয়া পল্টনের কার্যালয়ের সামনে আনা হলে অশ্রুজলে প্রিয় নেতাকে শেষ শ্রদ্ধা জানায় নেতা-কর্মীরা। জানাযায় অংশগ্রহণ করে সকল দলের নেতাকর্মীরা।
প্রথমে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রয়াত নেতার কফিনটি দলীয় পতাকা দিয়ে মুড়িয়ে দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর দলের পক্ষ থেকে কারাবন্দি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে কফিনে ফুল দেওয়া হয়।
কালো কাপড়ে মোড়া অস্থায়ী মঞ্চে রাখা হয় খোকার কফিন। নেতা-কর্মীদেরকে কফিনের সামনে কাঁদতে দেখা যায়। বিএনপি মহাসচিবসহ নেতারাও অশ্রুসজল ছিলেন।
নেতা-কর্মীদের উদ্দেশ্যে মির্জা ফখরুল বলেন, আমাদের সকলের প্রিয় নেতা, দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা, দুই বারের নির্বাচিত ঢাকার সাবেক মেয়র, সাবেক মন্ত্রী, সাবেক সংসদ সদস্য, ঢাকা মহানগরের সাবেক সভাপতি সাদেক হোসেন খোকা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। এমন এক সময় চলে গেলেন যখন আমাদের দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারাগারে। তিনি তাকে শেষ দেখা দেখতে পারলেন না। তিনি বলেন, আজকে এই ফ্যাসিবাদী সরকারের নির্যাতনে সারা বাংলাদেশের মানুষ যখন অত্যাচারিত, লাঞ্ছিত, সেই সময়ে যে মানুষগুলো ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল সাদেক হোসেন খোকা তার অন্যতম। তিনি চলে গেছেন; তার বর্ণাঢ্য রাজনীতির কথা বলার সময় নয়।
তিনি বলেন, সাদেক হোসেন খোকার এই অকালে চলে যাওয়ায় যে রাজনৈতিক শূণ্যতা সৃষ্টি হলো তা পুরণ হওয়ার নয়। আল্লাহ তালার কাছে দোয়া করি তিনি যেন তার সকল গুনাহ মাফ করে দেন, তাকে বেহেশত নসিব করেন।
দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের প্রতি পরিবারের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে খোকার বড় ছেলেন প্রকৌশলী ইশরাক হোসেন বাবার আত্মার মাগফেরাতের জন্য দোয়া চান। ইশরাক প্রশ্ন রেখে বলেন, আজকে যে পর্যায়ে পৌঁছেছি, বিএনপির যারা আহত, নিহত ও অত্যাচারের শিকার হয়েছেন, তাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বলতে চাই, এই রাজনীতির চর্চা কত দিন চলবে? বাংলাদেশে দু’জন অভিভাবক আছেন, একজন খালেদা জিয়া, যিনি জেলে আছেন। আরেকজন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আমি প্রশ্ন রাখতে চাই, আমাদের ভবিষ্যৎ কোথায়? আপানারা এর সমাধান করে দেন।
প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে ইশরাক বলেন, খালেদা জিয়ার জামিনের যে বাধাগুলো আছে, সেগুলো দূর করেন। আশপাশের স্বার্থবাদীদের বাদ দিয়ে খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথা বলেন। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ঠিক করে দিয়ে যান। আমরা যারা নতুন প্রজন্ম, তারা চাই না আর কোনো বিএনপি পরিবার এই প্রতিহিংসার রাজনীতির শিকার হোক এবং অন্য দল যদি ক্ষমতায় আসে, তখন আওয়ামী লীগের কোনো পরিবার প্রতিহিংসার শিকার হোক। আমাদের অভিভাবক যারা আছেন, তাদের এর সমাধান করে দিয়ে যেতে হবে। অন্য কারও দিয়ে এটা হবে না। যারা বাবাকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে এসেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি, বাবার জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।
দলীয় কার্যালয়ের সামনের খোকার ৩য় জানাজায় ইমামতি করেন উলামা দলের আহ্বায়ক মাওলানা শাহ নেছারুল হক। এরপর তার কফিনে স্যালুট জানায় সেক্টার কমান্ডার শাহজাহান ওমরের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল। সকাল ৮টা থেকে বিএনপি’র নয়া পল্টনের অফিসের নিচ তলায় কোরানখানি অনুষ্ঠিত হয়।
নয়া পল্টনের কার্যালয় থেকে ফকিরেরপুল মোড় পর্যন্ত সড়ক ও তার আশ-পাশের গলিতে হাজার হাজার নেতা-কর্মী-সমর্থক জানাজায় দাঁড়ান। পুরো পল্টন রোড কানায় কানায় পূর্ণ হয়। তখন ফুটপাতে হিন্দু-বৌদ্ধ-খৃষ্টান ধর্মাবলম্বীরাও মাথা নিচু করে শ্রদ্ধা জানান।
সেখান থেকে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় নগর ভবনে। বিকেল ৩টায় সেখানে ৩য় জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর গোপিবাগ ব্রাদার্স ক্লাব মাঠে বিকেল ৪টায় ৪র্থ জানাযা হয় এবং সর্বশেষ ধুপ খোলা মাঠে ৫ম জানাযা জানাজা শেষে জুরাইন কবরস্থানে বাবা-মায়ের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় এই বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবিভক্ত ঢাকার সাবেক নগর পিতাকে।
এদিকে খোকাকে সম্মান দেখিয়ে বৃহস্পতিবার (৭নভেম্বর) এক দিনের ছুটি ঘোষণা করেছে ঢাকা দক্ষিণ ও উত্তর সিটি কর্পোরেশন।
খোকার মরদেহ কবরে নামানোর আগে ক্র্যাক প্ল্যাটুনের এই গেরিলা কমান্ডারকে পুলিশের ১৭ সদস্যের একটি চৌকস দল ঢাকা জেলা প্রশাসনের সহকারী কমিশনার আবদুল আউয়ালের নেতৃত্বে রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়। তারা এই মুক্তিযোদ্ধাকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে আবদুল্লাহ আল নোমানের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা স্যালুট জানানো হয় সাদেক হোসেন খোকাকে। এসময় পুলিশের এডিসি নাজমুন নাহারসহ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, গত সোমবার (৪ নভেম্বর) বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টায় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যানহাটনে স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যানসার সেন্টারে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সাদেক হোসেন খোকা। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৬৭ বছর। ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ২০১৪ সালের মে মাসে সস্ত্রীক দেশ ছেড়েছিলেন একসময়ে ঢাকার এই দাপুটে নেতা। তখন থেকেই সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি।