রবিবার, ১৩ই অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

রবিবার, ১৩ই অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ রবিবার, ১৩ই অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৮শে আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ই রবিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি

ঘুষ স্বাস্থ্যের জন্য খুবই ক্ষতিকর

ঘুষ’- মাত্র দুটি বাংলা অক্ষরের একটি শব্দ। কিন্তু এর প্রভাব-প্রতিপত্তি ব্যাপক। অনেক ক্ষমতা এই ঘুষের। এই ঘুষ অসাধ্যকে সাধন করতে পারে। আপনার ফাইল চাপা পড়ে আছে, কিছুতেই সচল করতে পারছেন না? ঘুষের আশ্রয় নিন, দেখবেন ফাইল আপনার ধারণার চেয়েও দ্রুত গতিতে চলতে শুরু করেছে। ঘুষের ক্ষমতা অপরিসীম। ঘুষের দাপট এখন সর্বব্যাপী। বিশেষ করে সরকারি-আধা সরকারি অফিসে এর সার্বক্ষণিক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। সরকারি অফিসগুলোর দেয়ালও ঘুষ খায়-এমন একটি প্রবচন চালু আছে আমাদের সমাজে। ঘুষকে আবার শুদ্ধ বাংলায় বলে উৎকোচ।

আবার কখনো কখনো ভদ্রতার লেবাস চড়িয়ে ওটাকে বলা হয় ‘উপরি’। বিয়ের বরের আয়-রোজগার সম্বন্ধে কনের বাড়ির লোকজনকে ধারণা দেওয়ার সময় ঘটক বলে থাকে- ছেলে বেতন যা-ই পাক, উপরি বেশ ভালোই পায়। সেই উপরি এখন আরো আধুনিক হয়ে ‘স্পিড মানি’তে রূপ নিতে যাচ্ছে। কেন এই রূপ-রূপান্তর? নামের এই নব্য সংস্করণের যথার্থ কারণও আছে। ওটা দিলে যেকোনো ফাইল বা কাজের স্পিড বেড়ে যায়। সে হিসেবে ঘুষের এই নতুন নামকরণ সার্থক।

ঘুষ সম্পর্কে ব্রিটিশ আমলের একটি মজার গল্প রয়েছে। অর্ধশিক্ষিত এক লোক সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে জমি রেজিস্ট্রি করতে গেলে সাব-রেজিস্ট্রারের সহকারী ঘুষ দাবি করল। লোকটি রেগে ইংরেজ সাব-রেজিস্ট্রারের কাছে গিয়ে তার সহকারীকে দেখিয়ে বলল, “হি ইট ঘুষ স্যার, হি ইট ঘুষ।” লোকটি ঘুষের ইংরেজি প্রতিশব্দ জানত না। আর সাব-রেজিস্ট্রার সাহেবও বাংলা শব্দ ঘুষের অর্থ বুঝতে পারতেছিলেন না। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, হোয়াট ইজ ঘুষ? সহকারী দৌড়ে বাইরে গিয়ে দোকান থেকে এক কাঁদি কলা  এনে বসের টেবিলে রেখে বলল, “দিস ইজ ঘুষ  স্যার।” সাব-রেজিস্ট্রার সাহেব সামনে রাখা কলার খোসা ছাড়িয়ে খেতে খেতে মাথা দুলিয়ে বলতে থাকলেন, ‘ঘুষ ইজ গুড ফর হেলথ। তোমরা সবাই এখন হতে ডেইলি ঘুষ খাবে।’

কিন্তু মূলত এই ঘুষ যে স্বাস্থ্যের জন্য কত ক্ষতিকর সেটা যারা ঘুষ খান তারাই ভালো জানেন। ঘুষখোর ব্যক্তি সামাজিক এবং ধর্মীয় সর্বক্ষেত্রে পরিত্যাজ্য। ঘুষখোর ব্যক্তির পরিবারে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন সমস্যা বিরাজমান।

আগে ঘুষ খাওয়ার ব্যাপারে পুলিশের বদনাম ছিল। এখন আর ঘুষের রাজ্যে পুলিশের একচেটিয়া আধিপত্য নেই। সেখানে এখন থাবা বসিয়েছে সরকারি-আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সব দপ্তর। ওইসব দপ্তরের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারীও এখন ঘুষ নামের অতি সুস্বাদু বস্তুটি গিলে চলেছে।

কোথায় নেই ঘুষের দাপট? সারাজীবন চাকরি শেষে অবসরে গেছেন। পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্র্যাচুইটির টাকা তুলতে যাবেন, দেখবেন আপনারই প্রাক্তন কলিগ কথা বলছেন না। হাত গুটিয়ে বসে থাকছেন। আপনার ফাইলটি কোথায় কী অবস্থায় আছে, তাও তিনি বলতে পারছেন না। কিন্তু আপনি যেই তাকে কিছু দেওয়ার ইঙ্গিত দিলেন, অমনি তার ওষ্ঠাধরে হাসির রেখা ফুটে উঠল এবং ‘আরে ভাই, আগে বলবেন তো’ বলেই আপনার ফাইলের সন্ধানে তৎপর হয়ে উঠবেন।

আপনি ঠিকাদার, টেন্ডারের কাজ করেছেন। এখন বিল তুলতে এসেছেন। সংশ্নিষ্ট দপ্তরের কর্তা ব্যক্তিটি এত ব্যস্ত যে আপনার দিকে তাকানোর ফুরসত তার নেই। বুদ্ধি করে আপনি ইশারা করুন সেই সুস্বাদু খাদ্যের। দেখবেন তার সব ব্যস্ততা শুরু হয়ে যাবে আপনার বিলকে ঘিরে। কত শিগগির বিলটি পাস করানো যায়, সে জন্য তিনি হয়ে পড়বেন গলদঘর্ম। তখন আপনার চেয়ে তার গরজই বেশি হয়ে উঠবে।

ঘুষের প্রসঙ্গটি অতিসম্প্রতি সামনে এনেছেন দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। বলেছেন, ‘পদ্ধতিগত কারণেই বাংলাদেশে ঘুষ খাওয়া সবচেয়ে সহজ কাজ। যাদের মান-সম্মানের ভয় নেই, আত্মমর্যাদা নেই, তাদের পক্ষে ঘুষ খাওয়া সত্যি সহজ।’ গত ২৪ ফেব্রুয়ারি দুদকের প্রধান কার্যালয়ে ‘ভূমি ব্যবস্থাপনা’ শীর্ষক এক প্রশিক্ষণ কর্মসূচির উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এ মন্তব্য করেন তিনি। দুদক চেয়ারম্যান আরো বলেছেন, ‘ঘুষখোরদের আইনের আওতায় এনে লজ্জা পাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’ দুদক চেয়ারম্যানের মন্তব্যের সঙ্গে কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন বলে মনে হয় না। তার এ বক্তব্যের প্রতিফলন আমরা চোখের সামনে হরহামেশাই দেখতে পাই।

এক লোক তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নির্লজ্জের মতো কাজের বিনিময়ে টাকা নিচ্ছে সেবা গ্রহণকারীর কাছ থেকে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ গিয়েছিলেন চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা পরিদর্শনে। সেখানে তার কাছে সার্ভেয়ার পরমেশ্বর চাকমার বিরুদ্ধে ফাইল আটকে হয়রানির অভিযোগ করেন এক ব্যক্তি। মন্ত্রী ওই সার্ভেয়ারকে ডেকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘ফাইল আটকে মানুষকে হয়রানি করেন। সরকার বেতন দিচ্ছে, তারপরও হারামের পয়সা খাচ্ছেন?’ মন্ত্রীর কারণে ওই ব্যক্তি হয়তো হয়রানি থেকে বেঁচে গেছেন। কিন্তু তিনি তো দেশের সব ভূমি অফিসে প্রতিদিন যাবেন না।

প্রয়োজনীয় কাজে যারা ভূমি অফিসে পা রাখেন, তারা বোঝেন কত ধানে কত চাল! লক্ষণীয়, দুদক চেয়ারম্যান যে অনুষ্ঠানে ঘুষের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, সেটাও ছিল ভূমি বিষয়ে। সে হিসেবে সঠিক জায়গাতেই তিনি কথাগুলো বলেছেন। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, ‘সরকারি কর্মচারীদের সব প্রয়োজন সরকার মেটাচ্ছে। তারপরেওও কেন তারা ঘুষ খাবে, দুর্নীতি করবে?’ এ প্রশ্নের কোনো জবাব কারো কাছে আছে কি-না আমার জানা নেই।

ঘুষের একটি ‘চেইন অব ডিস্ট্রিবিউশন’ আছে। নিম্ন থেকে উচ্চ পর্যায়ে এর বিতরণ চলে। কোনো কোনো দপ্তরে নাকি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিম্ন পদস্থদের অঙ্ক নির্ধারণ করে দেন প্রতি মাসে কত পাঠাতে হবে। শোনা যায়, আজকাল সরকারি চাকরি পেতে মেধা-যোগ্যতার পাশাপাশি ঘুষ প্রদানের সামর্থ্যও একটি বড় যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত।

একটি সরকারি অফিসের পিয়নের চাকরি পেতেও নাকি ৫ লাখ পর্যন্ত গুনতে হয়। পুলিশের এক কনস্টেবলের চাকরি পেতে লাগে ৮-১০ লাখ। যত ওপরের পদে যাবেন, টাকার অঙ্ক তত বড় হবে। তো যারা এ বিপুল পরিমাণ টাকা ব্যয় করে চাকরি হস্তগত করে, চাকরিতে প্রবেশের পর তারা সে টাকাটা বৈধ-অবৈধ উপায়ে তো আদায় করে নেওয়ার চেষ্টা করবেই। তারপর আছে প্রমোশন, পোস্টিং ইত্যাদি। সেখানেও চলে টাকার খেলা।

অবৈধ অর্থোপার্জনের নেশা মানুষকে কতটা নিচে নামাতে পারে, তার একটি উদাহরণ পাওয়া গেল গত ২ মার্চ সমকালের একটি প্রতিবেদনে। তাতে বলা হয়েছে, অবৈধ অর্থোপার্জনের সুযোগ হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কায় খাদ্য অধিদপ্তরের এক দল পরিদর্শক প্রমোশন নিতে নারাজ। কারণ, খাদ্যগুদামগুলো থাকে এসব পরিদর্শকের নিয়ন্ত্রণে। চলতি জানুয়ারি মাসে অধিদপ্তরের ২৫৮ জন পরিদর্শকের নাম পদোন্নতির তালিকাভূক্ত করা হলেও তাদের মধ্যে ২৮ জনের নাম গেছে এসিআর ছাড়া।

উল্লেখ্য, এসিআর ছাড়া সরকারি অফিসে কারও প্রমোশন হয় না। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নানা অজুহাতে তারা এসিআর পাঠায়নি, যাতে তাদের প্রমোশন আটকে থাকে। উদ্দেশ্য গুদামের ‘মালিক’ হয়ে নানা পন্থায় অর্থ-কড়ি ট্যাঁকে গোঁজা। বুঝুন এবার! চাকরিজীবনে নিয়মিত পদোন্নতি একজন চাকরিজীবীর পরম আরাধ্য বলেই বিবেচিত। অথচ ওই ২৮ জন কর্মকর্তা স্বেচ্ছায়-সজ্ঞানে তাদের পদোন্নতির পথে ব্যারিকেড দিয়ে বসে আছে! খাদ্য অধিদপ্তরের দুর্নীতির খবর প্রায় সময়ই গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়, কারা সেসবের হোতা এবং কেনই-বা তারা পদোন্নতিবঞ্চিত থাকতে চায়। সচেতন ব্যক্তিরা বলছেন, ওই ২৮ জন খাদ্য পরিদর্শকের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।

খুঁজলে এমন ঘটনা আরও হয়তো পাওয়া যাবে। দুদক চেয়ারম্যান বলেছেন, ঘুষখোরদের লজ্জা নেই। নিরেট সত্য কথা। ঘুষখোররা এখন আর লজ্জা-শরমের ধার ধারে না। আগে ঘুষ লেনদেন হতো গোপনে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। এখন তা হয় প্রকাশ্যে। রীতিমতো তা নিয়ে হয় দরকষাকষি।

ঘুষ নিয়ে কথাবার্তা, লেখালেখি কম হয়নি। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে কঠোর হুঁশিয়ারিও শোনা যায় ঘুষখোরদের বিরুদ্ধে। কিন্তু পরিস্থিতির পরিবর্তন নেই। কেন নেই? কারণ এই অপরাধটির বিরুদ্ধে আইন থাকলেও তার প্রয়োগ নেই। নেই কার্যকারিতা। দুদক চেয়ারম্যান বলেছেন এদেরকে আইনের আওতায় এনে লজ্জা দেওয়ার কথা। কিন্তু সেটা কতটুকু সম্ভব হবে বা আদৌ সম্ভব হবে কি-না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। কারণ ঘুষ নামক রোগটি আমাদের জাতির দেহে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছে যে, তার যেন আর নিরাময় নেই। দুদক চেয়ারম্যান ঘুষ খাওয়াকে সবচেয়ে সহজ কাজ বলেছেন। সেই সহজ কাজটিকে যদি সবচেয়ে কঠিন করে দিতে পারেন, তাহলে তিনি অবশ্যই অভিনন্দিত হবেন।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Telegram
WhatsApp
Email
Print