মঙ্গলবার, ২৪শে জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

মঙ্গলবার, ২৪শে জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ মঙ্গলবার, ২৪শে জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১০ই আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৭শে জিলহজ ১৪৪৬ হিজরি

রিফাতের খুনীরা ২ প্রভাবশালী পরিবারের ছত্রচ্ছায়ায়

প্রভাতী ডেস্ক: বরগুনা-১ আসনের সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তাঁর ছেলে সুনাম দেবনাথ জেলা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। সবাই আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হলেও শম্ভু ও দেলোয়ার পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক সাপে নেউলে। তবে শাহ নেওয়াজ রিফাত শরীফের খুনিদের পক্ষ নিয়েছে দুটি পরিবার। এ কারণেই প্রকাশ্যে খুনের পরেও এখনো ঘাতকরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

গত বুধবার সকালে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে স্ত্রীর সামনে রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির বর্ণনায়ও ঘাতকদের নাম আসে।

বরগুনা পুলিশ লাইন এলাকার মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের মেয়ে আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির সঙ্গে ২ মাস আগে সদর উপজেলার বুড়িরচর ইউনিয়নের বড় লবণগোলা গ্রামের আব্দুল হালিম দুলাল শরীফের ছেলে রিফাত শরীফের বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে কলেজ এলাকার সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ড মিন্নিকে উত্ত্যক্ত করে আসছে। রিফাত এর প্রতিবাদ করলে নয়নের সঙ্গে তাঁর বিরোধ সৃষ্টি হয়। এর জের ধরে স্ত্রীর সামনে রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করে নয়ন ও তার সহযোগীরা।

খুনের মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহমেদ নয়ন স্থানীয় লোকজনের কাছে নয়ন বন্ড হিসেবেই পরিচিত। জেমস বন্ডের “০০৭” ছবি দেখে নিজের নামের পরে বন্ড শব্দটি যুক্ত করে। তার জীবনের কালো অধ্যায়ের শুরুটা মারামারি দিয়ে, তাও হত্যাচেষ্টার মাধ্যমে। ২০১১ সালের ১৭ জুলাইয়ের ঘটনার পর নয়ন একটুও দমেনি। উল্টো ওই ঘটনার পর আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ওই ঘটনার ঠিক এক মাস পর ১৮ আগস্ট আবারও আরেকজনকে হত্যার চেষ্টা চালায় সে। এই দুটি ঘটনায় থানায় হত্যা প্রচেষ্টার অভিযোগে মামলা দায়েরের পর নয়নের নাম আলোচনায় উঠে আসে। রাজনৈতিক নেতাদেরও দৃষ্টি পড়ে তার ওপর।

পুলিশের একটি সূত্র বলছে, অস্ত্র, মাদক, চুরি আর মারামারির ঘটনায় বরগুনায় সদর থানায় নয়নের বিরুদ্ধে আটটি মামলা দায়ের হয়েছিল। এর মধ্যে ২০১৭ সালেই অস্ত্র-মাদকসহ তিনটি মামলা দায়ের হয়েছে। পুলিশের পরিসংখ্যান বলছে, ওই তিনটি মামলার পর দীর্ঘ দুই বছরে আর কোনো মামলা দায়ের হয়নি। কারণ হিসেবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের একটি সূত্র বলছে, রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় থাকার কারণে পুলিশ নয়নকে গ্রেপ্তার করেনি। তাছাড়া ওই সময় থেকেই নয়ন পুলিশের সোর্স হিসেবেও কাজ করত বলে জানা গেছে।

অভিযোগ রয়েছে, নয়নের সঙ্গে সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভুর ছেলে সুনাম দেবনাথের ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। এর আগে জেলা ছাত্রলীগের একাংশ সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছিল সুনাম মাদক কারবারি। এ নিয়ে সংবাদও প্রকাশিত হয়েছিল। যেহেতু নয়ন মাদক কারবারি, তাই সুনামের সঙ্গে তার যোগসূত্রের কথা খোদ স্থানীয় আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারাই বলছেন। তাঁরা বলছেন, রাজনৈতিক দলের ছত্রচ্ছায়ায় না থাকলে এত বড় অঘটন ঘটানো সম্ভব নয়। তাছাড়া একাধিক মামলার আসামি প্রকাশ্যে আসতেও পারে না।

এ প্রসঙ্গে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নয়ন সন্ত্রাসী। তার বিরুদ্ধে কলেজ রোডের একাধিক বাসিন্দা মৌখিক অভিযোগ করেছিল। আমি প্রতিবাদ করিনি। কারণ প্রতিবাদ করলে নিজদলীয় নেতাদের রাজনীতির শিকার হব। তা ছাড়া নয়ন পুলিশের সোর্স হিসেবে কাজ করত বলে শুনেছি। পুলিশের পাশাপাশি রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় অপরাধ করায় কেউ তাকে দাবাতে পারেনি। ’ কোনো রাজনীতিবিদ ঘটনায় জড়িত কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সময় এলেই বলব। ’

রিফাত শরীফ খুনের পর থেকেই সুনাম দেবনাথ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবির পাশাপাশি রিফাত ফরাজী ও তাঁর ভাই রিশান ফরাজীর শাস্তি দাবি করেছেন। এ ঘটনার সঙ্গে তিনি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে ইঙ্গিত করে নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেইজে পোস্টও দিয়েছেন। তবে সেই পোস্টে নয়নের ব্যাপারে কিছুই লেখেননি। শুধু তা-ই নয়, সুনাম দেবনাথ ঘটনার জন্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের আত্মীয়কে দায়ী করে বিভিন্ন মিডিয়াতে বক্তব্যও দিয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে সুমন দেবনাথ বলেন, ‘নয়নের নেতৃত্বে রিফাত ও তার ভাই রিশান বিভিন্ন অপকর্ম করে আসছিল। সম্প্রতি জেলা পরিষদের ডাক বাংলোয় রিফাত ঘটা করে জন্মদিন পালন করেছে। তার মানে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে তাদের পারিবারিকভাবে যোগাযোগ রয়েছে। মূলত জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের প্রভাবেই তারা অনেকটাই বেপরোয়া। রাজনীতিক দলের ব্যানারে তারা এই অপকর্ম করলেও আমি বাধা দেইনি। কারণ তারা এটাকে রাজনৈতিকভাবে বিরোধিতা করবে। ’

বরগুনা জেলার পুলিশ সুপার বলেন, ‘নয়ন চিহ্নিত মাদক কারবারি। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক, মারামারি আর চুরির ঘটনায় আটটি মামলা রয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। ’ তিনি আরো বলেন, ‘নয়ন পুলিশের সোর্স নয়। তবে নয়ন যেহেতু মাদক কারবারি, তাই কারবার চালিয়ে নেওয়ার জন্য নিজেকে পুলিশের সোর্স হিসেবে পরিচয় দিতেও পারে। ’

রিফাত হত্যা মামলার অন্যতম ২ আসামি রিফাত ফরাজী ও তার ভাই রিশান ফরাজী। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেনের ভাইরার ছেলে তারা। মামলার অন্যতম আসামি হলেও পুলিশ তাদের এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি। রিফাতের বিরুদ্ধে মাদক কারবারের অভিযোগসহ বিভিন্ন অভিযোগে বরগুনা সদর থানায় অন্তত চারটি মামলা রয়েছে। বরগুনা সরকারি কলেজে বখাটেপনার দায়ে পুলিশ তাকে দুইবার আটক করেছিল। কিন্তু কলেজ কর্তৃপক্ষ কোনো মামলা না দেওয়ায় পুলিশ মুচলেকা রেখে রিফাতকে ছেড়ে দেয়।

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘রিফাত ও রিশান আমার আত্মীয়। তারা চিহ্নিত বখাটে। তাদের সঙ্গে আমার পারিবারিকভাবেই কোনো সম্পর্ক নেই। ’ ডাকবাংলোয় রিফাতের জন্মদিন পালন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি এ ব্যাপারে অবগত নই। ’
দেলোয়ার দাবি করেন, ‘রাজনৈতিকভাবে হেয় করার জন্যই আওয়ামী লীগের একটি পক্ষ আমার বিরুদ্ধে লেগেছে। এর আগে তারা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছিল। আমি রিফাত শরীফ খুনের ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি। একই সঙ্গে রিফাত ও রিশানের শাস্তি দাবি করছি। ’

Facebook
Twitter
LinkedIn
Telegram
WhatsApp
Email
Print