সাবেক ইউপি সদস্য হারুনুর রশিদ। বয়স ৩৪। হঠাৎ তিনি খুব পরিচিত কণ্ঠের গায়েবি আওয়াজ শুনতে পান। গায়েবি আওয়াজে তাকে গালাগাল করা হয়। এলোমেলো হয়ে যায় তার ফেসবুক। ব্যবহৃত আইফোনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডাউনলোড হয় পাবজিসহ পাঁচটি গেমস। এমনকি কয়েক দফায় তার ব্যাংক হিসাব থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ গায়েব হয়ে যায়।
এতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি। একান্ত আপনজনদের কেউই তার এসব ভূতুড়ে বিষয় বিশ্বাস করেনি। তারা বরং বানায় হাসি-ঠাট্টার রসদ। এরপর ‘মস্তিষ্ক হ্যাক’র অভিযোগে মামলা করে রীতিমতো সারাদেশে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন তিনি। এবার তার মাথা থেকে সফল অস্ত্রোপচার করে একটি ক্ষুদ্র ডিভাইস বের করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন তার চিকিৎসক ও আইনজীবী। হারুনুর রশিদের বাড়ি কক্সবাজারের কুতুবদিয়ার আলী আকবার ডেইল ইউনিয়নের সিকদারপাড়ায়। তিনি ডেইল ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য।
জানা যায়, কক্সবাজারে এক চিকিৎসকের চেম্বারে সম্প্রতি হারুনের মাথায় সফলভাবে অস্ত্রোপচার করা হয়। তখন হারুনের আইনজীবী শাহারিয়ার মোহাম্মদ তুহিনসহ আরো কয়েকজন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। অস্ত্রোপচারের সম্পূর্ণ দৃশ্যও তারা রেকর্ড করেছেন। হারুন এর আগে ‘মস্তিষ্ক হ্যাক’র অভিযোগে সন্দেহভাজন দুজনকে অভিযুক্ত করে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) এবং সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছিলেন।
হারুনের মাথায় অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম গোপন রাখা হলো) বলেন, মাথার চামড়া এবং অক্সিপেটাল বোনের মাঝখানে একটি ক্ষুদ্র ফরেইন বডি খুঁজে পেয়েছি। ফরেইন বডির নিচের অংশে দুটি সুচালো অংশ ছিল যার দ্বারা এটি অক্সিপেটাল হাড়ের পেশির পৃষ্ঠে সংযুক্ত ছিল।
দুটি গর্ত স্পষ্টভাবে দৃশ্যমান ছিল, যা এই দুটি তীক্ষ্ণ অংশের দীর্ঘস্থায়ী সংযুক্তির সম্ভাব্য ফলাফল। উদ্ধার হওয়া ‘ফরেন বডি’র দৃশ্যমান পৃষ্ঠটি স্টেইনলেস স্টিলের মতো চকচকে, কয়েকটি চালের দানার আকৃতির এ ছোট্ট ডিভাইস শক্তিশালী ম্যাগনেটিক শক্তিসম্পন্ন ছিল, এটি কাঁচির সঙ্গে খুব শক্তভাবে আটকে থাকে।
হারুনের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শাহারিয়ার মাহমুদ তুহিন বলেন, শুরুতে অদ্ভুত ও অসম্ভব মনে হলেও আগ্রহের বশবর্তী হয়ে চালাই নেট সার্ফিং। শুরু হয় সাইকোট্রনিক অ্যাটাক, ব্রেইন টু ব্রেইন কমিউনিকেশন ইত্যাদির বিষয়ে শেখার পালা। উন্নত দেশগুলোতে এসপিওনাজ লেভেলে এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যাপক গবেষণা চলে আসছে বহুদিন ধরে। শুরুতে প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি পাওয়া না গেলেও ধীরে ধীরে ইন্টারনেট থেকে এ বিষয়ে খুঁজে পাই পড়ার মতো, জানার মতো অনেক কিছু।
একপর্যায়ে শুরু থেকে সবকিছু দিবালোকের মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। এরপর হারুনের পক্ষে সাইবার ট্রাইব্যুনালের মামলা পরিচালনার দায়িত্ব নেই। প্রথম ও দ্বিতীয় অপারেশনের সময় আমি তার পাশেই ছিলাম। দ্বিতীয়বারের অপারেশনে মাইক্রো-চিপ উদ্ধার হওয়ার সব ঘটনা আমি নিজ চোখে দেখেছি।
তিনি আরো বলেন, চলতি বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি বিভাগীয় সাইবার ট্রাইব্যুনাল চট্টগ্রামে যাবতীয় বিষয় উল্লেখ করে হারুনের পক্ষে মামলা করি। ট্রাইব্যুনাল মামলাটি সিআইডিকে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন। এখন সেটি তদন্তাধীন আছে।
এদিকে মানুষের মস্তিষ্ক নিয়ন্ত্রণ করা যায় এবং তিনি নিজে এর শিকার দাবিতে অনড় থেকে এর শেষ দেখতে চান বলে জানিয়েছেন হারুন। তার মস্তিষ্ক হ্যাক নিয়ে অভিযোগের ভিত্তিতে ২০২১ সালের শেষের দিকে একটি জাতীয় পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর রীতিমতো সারাদেশে হইচই পড়ে যায়। অবশ্য তার অভিযোগ অনুসারে, মস্তিষ্ক আসলে হ্যাক করা সম্ভব কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। যদিও জিডি এবং মামলার তদন্ত কর্মকর্তারাও ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন ‘কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং’ বলে উল্লেখ করেছেন।
হারুন দাবি করে বলেন, বছর তিনেক আগে শ্বশুরবাড়িতে ঘুমন্ত অবস্থায় তার শ্যালিকা আসমা উল হোসনার সহযোগিতায় হ্যাকার চক্র ইনজেকশন পুশ করে তার মাথায় একটি ছোট ইলেকট্রনিক যন্ত্র (কম্পিউটার ডিভাইস) বা নিউরো চিপ স্থাপন করেছিল। এর আগে তাকে চায়ের সঙ্গে মিশিয়ে তার শ্যালিকা কিছু একটা খাইয়েছিল। চা পানের পর তিনি আনুমানিক ৪-৫ ঘণ্টা অচেতন হয়ে ঘুমে ছিলেন। জেগে খেয়াল করেন মাথায় হালকা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। সেখানে তিনি হাত দিয়ে হালকা রক্তপিণ্ডের অস্তিত্ব পান। এরপরই তিনি শ্যালিকাকে মাথা দেখিয়ে কী হয়েছে দেখতে বলেন। তখন শ্যালিকা নির্বিকার জবাব দেন, কোনো পোকার কামড়ে বা কোনো কারণে হয়তো একটুখানি রক্তের মতো দেখা যাচ্ছে।
হারুন বলেন, ঘটনার পরদিন থেকে আমি একজন খুব পরিচিত কণ্ঠের গায়েবি আওয়াজ শুনতে পাই। গায়েবি আওয়াজে আমাকে গালাগাল করে। আমার ফেসবুক এলোমেলো হয়ে যায়। ব্যবহৃত আইফোনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ডাউনলোড হয় পাবজিসহ পাঁচটি গেমস। কয়েক দফায় আমার ব্যাংক হিসাব থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ গায়েব হয়ে যায়। এরপর ক্রমাগতভাবে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। একান্ত আপনজনদের কেউই আমার এসব ভূতুড়ে বিষয় বিশ্বাস করেনি। তারা বরং আমাকে হাসি-ঠাট্টার রসদ বানায়।
পরে পরিচিত একজন আইটি বিশেষজ্ঞকে আমার আইফোনের বিচিত্র আচরণ ও ফেসবুকের ওপর আমার নিয়ন্ত্রণহীনতার বিষয়টি জানালে তিনি অ্যাপল, গুগল এবং ফেসবুক কর্তৃপক্ষের কাছে সন্দেহের বিষয়টি জানাতে বলেন। সে মোতাবেক তাদের কাছে বার্তা পাঠাই। একপর্যায়ে নিশ্চিত হই অ্যাপল আইডি হ্যাক করে আমার ফোনের আইটিউনসহ যাবতীয় সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ করছে হ্যাকাররা।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে আনা লো ফ্রিকোয়েন্সির মাইক্রোচিপ শনাক্তকারী ডিভাইস দিয়ে মাথায় নিউরো চিপের অস্তিত্ব শনাক্ত করা গেছে দাবি করে হারুন বলেন, এ শনাক্তকরণ ডিভাইসটি APTek CC308+ Anti-Spy Signal Bug RF Detector মডেলের। বিদেশি একজন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী একাধিকবারের চেষ্টায় এমআরআই টেস্টে আমার মাথায় ওই চিপ ধরা পড়ে।
তার এমআরআই পরীক্ষা চট্টগ্রামের এপিক হেলথ কেয়ার লিমিটেডে করেছে এবং সেই টেস্টেই মাথায় ডিভাইস শনাক্ত হয়েছে। এ বিষয়ে ওই হাসপাতালে যোগাযোগ করলে প্রতিষ্ঠানের জনসংযোগ কর্মকর্তা (পিআরও) কাউসার আলম বলেন, হাসপাতালের সংরক্ষিত তথ্যভান্ডারে হারুনুর রশিদ নামে ওই রোগীর এমআরআই পরীক্ষার ‘সত্যতা’ রয়েছে। ওই এমআরআই পরীক্ষার রিপোর্ট পেয়ে সম্প্রতি অপারেশন করে মাথা থেকে ক্ষুদ্র একটি ডিভাইস বের করা হয়।
হারুন আরো বলেন, তিনি কোনো অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন হাতে নিলে শরীর হালকা কেঁপে ওঠে। তার হাতের স্পর্শের পরপরই ফোনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাবজি গেমসসহ চার থেকে পাঁচটি ক্ষতিকর গেমস ডাউনলোড হয়ে যায়। হারুনের হাত দিয়ে স্পর্শ করা স্মার্টফোন মুহূর্তেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তির বা ডিভাইসের নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে বলে তার ধারণা। এতে ফোনে থাকা যাবতীয় ডকুমেন্ট ও সব ধরনের তথ্য সহজে হ্যাকাররা পেয়ে যাচ্ছে।
হারুন বলেন, কুতুবদিয়ার বাসিন্দা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আতিকুর রহমান নামে এক শিক্ষার্থী তার শ্যালিকা আসমা উল হোসনার সহযোগিতায় মাথায় ওই চিপ স্থাপন করে তার মস্তিষ্ক হ্যাক করেছেন। এমনকি তার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ক্লোন করে প্রায় ২০ লাখের বেশি টাকা উত্তোলন করেন।
হারুনের মতে, বিদেশি একটি মাথার ব্রেন হ্যাকার চক্র বাংলাদেশে রয়েছে। তাদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে দেশীয় কিছু হ্যাকার। যারা ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে চিপ (ক্ষুদ্র কম্পিউটার ডিভাইস) টার্গেট করা ব্যক্তিদের শরীরে স্থাপন করে এবং যাবতীয় তথ্য হাতিয়ে নেয়ার পাশাপাশি অর্থও লুটে নিচ্ছে। আতিকুর রহমানও ওই দলের একজন।
আতিকুরের মাথায়ও এমন নিউরো চিপ রয়েছে দাবি করে হারুন বলেন, হ্যাকারদের সঙ্গে ব্রেন টু ব্রেন কথা বলতে সক্ষম হচ্ছেন আতিকুর। তাদের মধ্যে নিয়মিত কথাও হচ্ছে। তাই হারুনের প্রত্যেকটি কথা শোনার পাশাপাশি তার গতিবিধি নজরদারি এবং দৈনন্দিন সব কার্যক্রম সম্পর্ক জানতে পারছে হ্যাকাররা।
হারুন দাবি করেন, সম্প্রতি এ বিষয়ে বাড়াবাড়ি না করে তাকে অপারেশন করে মাথা থেকে ওই নিউরো চিপ ফেলে দেওয়ার প্রস্তাব দেন হ্যাকার আতিকুর রহমান। তা না হলে তার মস্তিষ্ক থেকে সবকিছু মুছে পঙ্গু করে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে আতিকুর রহমান বলেন, হারুন একজন ইয়াবা ব্যবসায়ী। তার ইয়াবা ব্যবসা আড়াল করতে এসব নাটক সাজিয়েছেন। এর আগেও তিনি মস্তিষ্ক হ্যাক করেছি দাবি করে মামলা ও হাইকোর্টে রিট করেছিলেন-সেটা আদালত খারিজ করে দিয়েছেন।
থানায় জিডির পাশাপাশি ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করেছেন জানিয়ে হারুন দাবি করেন, প্রথমে মামলাটি ভুয়া ও হাস্যকর উল্লেখ করে নিতে চাননি আদালত। পরে হারুনের সব কথা শোনার পর মামলাটি গ্রহণ করে পুলিশের ঢাকার গোয়েন্দা বিভাগকে (ডিবি) তদন্তের ভার দেওয়া হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক মো. শামীম বলেন, বাদীর ফোনটি ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য পাঠানোর আগ মুহূর্তে লস মুডে চলে যায়। বিবাদীর একটি মোবাইল সেট জব্দ করা হয়েছিল। তবে ফোনে তেমন কিছু না পাওয়ায় মামলা নিয়ে অগ্রসর হইনি। তবে ভিকটিমের মাথায় যেহেতু এখন নিউরো চিপ পাওয়া গেছে। তিনি চাইলে মামলাটি আবার পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন।
হারুনের অভিযোগের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এসব সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা দেশে এ ধরনের অভিযোগ এর আগে আর কেউ করেননি উল্লেখ করে ঘটনাটি তদন্তের সক্ষমতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।
পরে হারুনকে নিয়ে কক্সবাজারের তৎকালীন সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মো. ফয়সাল আহমেদের সঙ্গে দেখা করে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। সবকিছু শোনার পর তিনি বলেন, আমি সিআইডির ক্রাইম বিভাগে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি। এর আগে বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তাই এ বিষয়ে কাজ করা বেশ কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং। সিআইডি ক্রাইম বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় করে বিষয়টি উদঘাটনের চেষ্টা করা হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালের পর থেকেই মস্তিষ্ক হ্যাকিংয়ের অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন আদালতে একাধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলার নথিপত্র পাওয়া গেলেও সর্বশেষ ফলাফল কী হয়েছে তা জানা যায়নি।