শুক্রবার, ৬ই জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শুক্রবার, ৬ই জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ শুক্রবার, ৬ই জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৩শে জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৯ই জিলহজ ১৪৪৬ হিজরি

ইতালি যাওয়ার পথে মাফিয়াদের হাতে বন্দী তরুণকে লিবিয়া থেকে ফিরিয়ে আনলেন মা !

প্রভাতী ডেস্ক : যে মা জীবনে কখনো দেখেননি নিজ দেশের রাজধানী, সেই মা তার একমাত্র ছেলেকে উদ্ধার করে আনলেন মাফিয়াদের বন্দিশিবির থেকে। এ যেন থ্রিলার মুভিকেও হার মানানো এক বাস্তব কাহিনী।

গ্রামীণ আট পৌঢ়ে জীবন ছেড়ে উড়োজাহাজে চড়ে সুদূর লিবিয়ায় মাফিয়া বন্দিশিবির থেকে ছেলেকে উদ্ধার করেন এই মা। অজপাড়াগাঁওয়ের শিক্ষাবঞ্চিত মা ত্রিপলী বিজয়ীর বাড়ি কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার কালিকাপুর গ্রামে। তিনি লিবিয়া প্রবাসী আবুল খায়েরের স্ত্রী শাহিনুর বেগম (৪৫)।

জানা যায়, দেবিদ্বার উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের আবুল খায়ের তার স্ত্রী, এক পুত্র ও দুই কন্যা ফেলে প্রায় ১১ বছর আগে ২০১১ সালে দালালের মাধ্যমে লিবিয়ায় পাড়ি জমান। এরই মধ্যে ২ কন্যাসন্তানের বিয়ে হয়ে যায়। অভাবের সংসারে আরও একটু সচ্ছলতা আনতে সপ্তম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ২০১৯ সালের মে মাসে একমাত্র ছেলে ইয়াকুব হাসানকেও নিয়ে যান লিবিয়ায়।

ইয়াকুব প্রথম এক বছর ‘আল হারুজ’ নামের একটি তেলের পাম্পে ৩৫ হাজার টাকায় এবং পরের এক বছর হাকজিলতন তেলের পাম্পে ৪৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করেন। পিতা-পুত্রের আয়ে ভালোই চলছিল তাদের সংসার। পরে হবিগঞ্জের দালাল জাহাঙ্গীরের খপ্পরে পড়ে অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে আরও উন্নত জীবনের স্বপ্নে ইতালির পথ ধরে ইয়াকুব।

লিবিয়ার রাজধানী ত্রিপলী থেকে নৌকায় করে ১৫০ জন ইতালি যাওয়ার পথে ল্যাম্ব দোসা দ্বীপে ‘মাফিয়াদের’ হাতে ধরা পড়েন তারা। ওখান থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য এক বাঙালি দালাল ধরে বাবার সহযোগিতায় চার লাখ টাকায় মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। দ্বিতীয় দফায় মাফিয়াচক্র লিবিয়ার কোস্টগার্ডের কাছে তাদের বিক্রি করে দেয়।

কোস্টগার্ড ওখান থেকে তাদের অন্য একটি দ্বীপে দালালদের কাছে বিক্রি করে দেয়। সেখানে চলে অমানবিক জীবন। একেকটি কক্ষে প্রায় ৬০-৭০ জনের অবস্থান। খাদ্য সংকট, শারীরিক নির্যাতনসহ নানা কারণে প্রতিদিনই মরছেন সঙ্গীরা। লাশের পঁচা গন্ধ, পেটের ক্ষুধা, পানিসংকট আর টাকার জন্য চলে বন্দুকের বাঁটের আঘাত ও পানির পাইপের পিটুনি। শরীরের ক্ষতচিহ্নে পচন ধরেছে ইয়াকুবসহ অন্যদের। প্রতিদিন একটি রুটি, কোনো দিন আধা রুটি খেয়ে শরীরের যন্ত্রণায় জীবন অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছে।

এ সংবাদে তার বাবা আবুল খায়ের স্ট্রোক করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এদিকে ছেলের এমন খবর শুনে মা শাহিনুর বেগম পাসপোর্ট এবং ভিসা লাগিয়ে চলতি বছরের ৯ জানুয়ারি লিবিয়া যান। সেখানে স্বামীর সঙ্গে লিবিয়ায় বেনগাজি অবস্থান করে দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে আইওএমের কর্মকর্তা এবং সেনাসদস্যদের সহযোগিতায় সেখান থেকে অর্থের বিনিময়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনেন। প্রায় ৬ মাসের বন্দিজীবন থেকে মুক্তি পায় ইয়াকুব।

শাহিনুর বেগম জানান, সবাই বলছিল আমার ছেলে মারা গেছে, তাকে মেরে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। চার দফায় ছেলেকে উদ্ধারের জন্য আমি ও আমার লিবিয়া প্রবাসী স্বামী দালালকে প্রায় ২০ লাখ টাকা দিয়েছি। ৬ মাসেও ছেলের কোনো খোঁজ না পেয়ে লিবিয়া প্রবাসী স্বামীর সহযোগিতায় পাসপোর্ট ও ভিসা নিশ্চিত করে নিজেই লিবিয়ায় চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।  লিবিয়ায় বাংলা ভাষা জানেন এমন কয়েকজনকে খুঁজে বের করে তাদের কাছে সব খুলে বলি। তারা আমাকে বাংলাদেশ দূতাবাস এবং জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। দূতাবাস ও আইওএমের কর্মকর্তারা সব শুনে আমাকে সাহায্য করেন।

ইয়াকুব হাসান জানান, আমাদের যেখানে রাখা হয় সেখানে সাতজন বাংলাদেশি আমাদের দেখাশোনার দায়িত্বে ছিল। তাদের একজনের নাম সুজন। বাকিদের নাম মনে নেই। তারাও মাফিয়াদের হাতে অনেক আগে ধরা পড়েছিল। তবে তারা মাফিয়াদের কিছুটা বিশ্বস্ত। এই সাতজন আমাদের নিয়মিত মারতেন। কোনো কথা ছাড়াই হাতের কাছে যা পেতেন তাই দিয়ে মারতেন। তাদের কোনো মায়া-দয়া ছিল না। তারাই আমাদের সবচেয়ে বেশি কষ্ট দিয়েছেন। আমাদের ৩০০ জনের জন্য প্রতিদিন ৩০০টি রুটি দেওয়া হতো। এই সাতজন ৩০টি রুটি রেখে বাকি ২৭০টি আমাদের দিতেন। আমাদের সেগুলো ভাগ করে খেতে হতো।

ইয়াকুব হাসান  আরও জানান, ‘আমাদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা একজনকে অনেক অনুরোধ করে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তার ফোনটি নেই। আমি শুধু বাবাকে জায়গার নাম বলি এবং কাউকে আর কোনো টাকা না দেওয়ার জন্য বলি। কারণ সব টাকা দালালরা খেয়ে ফেলে। বাবার সঙ্গে আমার ১৭ সেকেন্ড কথা হয়েছিল।

শাহিনুর বেগম জানান, আমাদের কাছে যারা টাকা নিয়েছে তাদের একজন এখন দেশে আছেন। তার বাড়ি হবিগঞ্জে। আমি তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব। আমি যদি টাকাগুলো ফেরত পাই তাহলে খুব উপকার হবে। আমি আইওএমের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। তারা আমার ছেলেকে উদ্ধার করে দিয়েছে।

শাহিনুর আক্তার আরও জানান, ‘আমি সুদে টাকা এনে, স্বর্ণ ও গরু বিক্রি করে চার লাখ টাকা খরচ করে লিবিয়ায় যাই। এখন আমার কিছু নাই। দেনার দায়ে জর্জরিত। কিন্তু ছেলেকে খুঁজে পেয়েছি, এটাই খুশি।’ তিনি বলেন, ‘ইয়াকুবের সঙ্গে লিবিয়ায় থাকতে আমার ফোনে কথা হয়েছে। দেখা হয়নি। ইয়াকুব দেশে ফিরেছে ১০ মার্চ। আমি ফিরি ১৬ মার্চ। ছেলেকে ফিরে পেয়ে খুশি।’

Facebook
Twitter
LinkedIn
Telegram
WhatsApp
Email
Print