
নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীর বড় মগবাজার। শহিদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়কে উলোট-পালোট হয়ে পড়ে আছে ৩টি বাস।
রোববার(২৭ জুন) রাত ৭টা ৩৪ মিনিটের দিকে এখানে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। বাসগুলোর চুরমার হওয়া গ্লাসের টুকরোয় লেগে আছে মানুষের রক্ত। বাসের ফ্লোরেও রক্তের ছাপ। রাস্তার দক্ষিণ পাশেই তিনতলা একটি বাড়ি। এর নিচতলা বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে আসবাবপত্র।
পাশের ৬ তলা বিশিষ্ট মগবাজার প্লাজায়ও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভবনের দরজা, জানালা ও দোকানের আসবাবপত্র ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে।
রাস্তার উত্তর পাশে বহুতল ভবনে আড়ংয়ের শোরুম, পাশে আরও প্রায় ৫টি ভবনের গ্লাস, কাঠের দরজা, জানালা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- প্রায় ১ হাজার ফুট এলাকাজুড়ে বিস্ফোরণের ক্ষত চিহ্ন।
সরেজমিন দেখা যায়, যে তিনতলা ভবনটি সবচেয় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেই ভবনের নিচতলায় প্রায় ১০টি কক্ষের দেওয়াল বলতে কিছুই নেই। ভবনের ভেতরে থাকা একটি বড় জেনারেটরসহ কিছু আসবাবপত্রও ছিটকে রাস্তায় পড়েছে। ওই ভবনের নিচতলায় বেঙ্গল মিট, শর্মা হাউজসহ আরো বেশ কয়েকটি দোকান ছিল, কোনোটারই কোনো অস্তিত্ব নেই। পাশের একটি দোকানের মালিক সাদ্দাম হোসেন জানান, তিনি শুধু একটি বিকট শব্দ শুনেছেন। এরপর চারপাশ অন্ধকারে ঢেকে যায়। পরে দেখেন পুরো এলাকায় ধ্বংসস্তূপ।
রাত সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাস্থল অর্থাৎ ফ্লাইওভারের নিচে দাঁড়িয়ে কাঁপছিলেন এক যুবক। কাছে যেতেই বললেন, উত্তরা যাচ্ছিলেন তিনি।
বিস্ফোরিত হয়ে পড়ে থাকা তিন বাসের অনেক পেছনের একটি বাসে ছিলেন, শব্দ শোনার পর সব যাত্রী ভয়ে চিৎকার শুরু করেন। একপর্যায়ে সামনে এসে দেখেন, তিনটি বাসের যাত্রীরা ভেতরে কাতরাচ্ছেন।
পথচারী, সাধারণ মানুষের সঙ্গে তিনিও বাসে উঠে আহতদের উদ্ধার করেন। তিনি বলেন, বাসের সব যাত্রীর শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল। তারা কাঁদছিলেন। অনেকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন।
রাত ১২টার দিকে মগবাজার প্লাজার নিচে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে হা-হুতাশ করছিলেন প্লাজাটির মালিক হারুন অর রশিদ। তিনি জানান, ৬ তলা মার্কেটটি তার। তিনি চারতলায় পরিবার নিয়ে থাকেন। হঠাৎ বিকট শব্দে সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন।
তাদের মনে হয়েছে পুরো ভবনটি যেন ভেঙে পড়ছে। বাসার গ্লাস, দরজা, জানালা ভেঙে ফ্লোরে-বারান্দায় পড়ছিল। মগবাজার প্লাজার তিন তলায় একটি টেইলার্সের মালিক সিদ্দিকুর রহমান, রাস্তায় দাঁড়িয়ে থরথর করে কাঁপছিলেন তিনি।
জানালেন, বিকট শব্দের সময় তিনিসহ ৪ জন দোকানে ছিলেন। মুহূর্তে দোকানের রেক, গ্লাস, শাটারগুলো ভেঙে যায়। সবাই ফ্লোরে বসে পড়েন। কিছুই বুঝতে পারেননি, মাত্র ১ মিনিটেই সব চুরমার হয়ে যায়। রাস্তার উত্তর পাশে আড়ং শোরুমটি একটি বহুতল ভবনের ৪ তলায়। পুরো তলার সবকটি গ্লাস ভেঙে পড়েছে।
এক সেলসম্যান জানান, এখানে যারা কাজ করছিলেন, কিছুই বুঝতে পারেননি, শুধু শব্দ শুনেছেন। এরপর দেখেন সব শেষ। রাস্তায় পড়ে থাকা সামনের বাসটির নাম মক্কা ট্রাভেল। খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন বাসটির মালিক জাহাঙ্গীর আলম বাবুল। জানালেন, দুর্ঘটনার পর বাসের ড্রাইভার তাকে ফোন করে জানিয়েছেন, বিকট শব্দে বাস ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে, তারপর তাকে ফোন করলেও ধরেননি।
পরে উত্তরা থেকে তিনি ঘটনাস্থলে আসেন। ব্যাংক থেকে ঋণ করে বাসটি কিনেছেন বলে জানান তিনি। রাত ১০টার দিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপির) কমিশনার শফিকুল ইসলাম ঘটনাস্থলে আসেন। তিনি জানান, তারা জানতে পেরেছেন, মগবাজারের শর্মা হাউজে গ্যাস বিস্ফোরণে আশপাশের ৭টি ভবন এবং ৩টি বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
রাত ১১টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন ঘটনাস্থলে এসে জানান, ৭টা ৩৪ মিনিটে খবর পেয়ে আমাদের টিম এখানে আসে। তিনতলা ভবনের নিচতলায় ফাস্টফুডের দোকান, দ্বিতীয় তলায় সিঙ্গারের একটি গোডাউন ছিল। বিস্ফোরণের কারণে ব্লাস্ট ওয়েভ ও সাউন্ড ওয়েভ সৃষ্টি হয়। এতে আশপাশের ভবনগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই ভবনের সব পিলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি বলতে পারি এই ভবন বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে গেছে।
গ্যাস বা এ জাতীয় কোনো কিছুর মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে অনুমান করে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বলেন, আমরা পরীক্ষা করছি। গ্যাস জাতীয় কিছু থেকে বিস্ফোরণ হতে পারে। কীভাবে এ বিস্ফোরণ ঘটল তা জানার জন্য তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
তারা প্রাথমিকভাবে ধারণা করছেন, গ্যাস থেকে এ বিস্ফোরণ। ভবনের নিচতলায় ফাস্ট ফুডের দোকান ছিল। দ্বিতীয় তলায় একটা শোরুম ছিল।
সেখানে ফ্রিজ ছিল। তিন তলায় ছিল একটা স্টুডিও। ভবনের সামনের সড়কে কাজ চলছে। সেখানেও গ্যাস ও ইলেকট্রিক তার রয়েছে। তাই এখনই নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বিস্ফোরণে ৭জন নিহত এবং অন্তত ৩৫ জন আহত হয়েছেন। অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় ৭ জনকে শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়েছে।