সোমবার, ৯ই জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সোমবার, ৯ই জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ সোমবার, ৯ই জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৬শে জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১২ই জিলহজ ১৪৪৬ হিজরি

৫ দফায় পৌরসভা নির্বাচন: আরো পিছিয়ে বিএনপি

প্রভাতী ডেস্ক : ৫ ধাপে অনুষ্ঠিত ২৩০টি পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে গতবারের তুলনায় আরো পিছিয়েছে বিএনপি। ভোট কমেছে ৬.৬৪ শতাংশ। ২০১৫ সালে দলটির প্রার্থীরা ২৪টিতে মেয়র পদে বিজয়ী হলেও এবার জয় পেয়েছেন ১১টিতে। এছাড়া ১০৩ জন প্রার্থী জামানত রক্ষার ভোটও পাননি। ফল বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এমন তথ্য।

বিশ্লেষণে আরো দেখা গেছে, মেয়র পদে ৫৯. ৯১ শতাংশই ভোট পেয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। দলটির ১৮৫ জন এ নির্বাচনে মেয়র পদে জয় পেয়েছেন। এর মধ্যে ১১ জনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত হন। তবে জয়ের এ ধারাবাহিকতার মধ্যেও দলটির ৩জন মেয়র প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন।

২০১৫ সালের তুলনায় এবার সরকারি দলের মেয়র ও ভোট দুইটিই বেড়েছে। ওই সময়ে অনুষ্ঠিত ২৩৫টি পৌরসভার মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৮২টিতে (৭জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়) জয় পায়। দলটি ভোট পায় ৫৩. ৫৪ শতাংশ। আগের তুলনায় এবার ভোট বেড়েছে ৬.৩৭ শতাংশ। অন্যদিকে এবার বিএনপি প্রার্থীদের ভোট পাওয়ার হার ২১.০৩ শতাংশ। ২০১৫ সালে ভোট পাওয়ার হার ছিল ২৭. ৬৭ শতাংশ।

এ নির্বাচনে প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সহায়তায় এ নির্বাচনে সরকারি দলের প্রভাব, অনিয়ম ও কারচুপির কারণে এমন ফলাফল এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির নেতারা। তাদের অভিমত-এটি মানুষের মতামতের প্রকৃত প্রতিফলন নয়। এ কারণে বিএনপি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বর্জন করছে।

অপরদিকে আওয়ামী লীগের নেতারা মনে করেন, বিক্ষিপ্ত ঘটনা ছাড়া নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।
সন্ত্রাস, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে মানুষ বিএনপি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় আওয়ামী লীগের ভোট বেড়েছে।

তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞদের মতে, ভোটের মাঠে সব দলের জন্য সমান সুযোগ (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) ছিল না। একচেটিয়াভাবে একটি দলের প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। নির্বাচনে সহিংসতা, অনিয়ম ও প্রভাব বিস্তারের ঘটনায় ব্যবস্থা নেয়নি ইসি। এমন অবস্থার মধ্যে আজ ভোটার দিবস উদ্যাপন করতে যাচ্ছে ইসি।

এই ধাপের পৌরসভা নির্বাচনের ফল প্রসঙ্গে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এটি ছিল সরকারি দল, প্রশাসন, পুলিশ ও নির্বাচন কমিশনের যৌথ উদ্যোগে কারচুপির ও অনিয়মের নির্বাচন। এতে ভোটারদের অংশগ্রহণ ছিল না। প্রশাসনের সহায়তায় সরকারি দল ভোট চুরি করায় এ ফলাফল এসেছে। এটা জনগণের মতামতের প্রতিফলন নয়।

তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ। তিনি বলেন, দেশের মানুষ উন্নয়ন ও অগ্রগতি দেখতে চায়। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হচ্ছি। এ কারণে মানুষ নৌকায় ভোট দেয়। বিএনপির সন্ত্রাস, দুর্নীতি, জঙ্গিবাদ সমর্থন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় দলটির ভরাডুবি হচ্ছে। তারা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। নির্বাচনে সহিংসতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ছাড়া শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ব্যক্তিগত, এলাকা, গোষ্ঠীগত ও পারস্পরিক দ্বন্দ্ব থেকে বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটে। অতীতেও এর নজির রয়েছে।

২৮ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি পাঁচ ধাপে ২৩০টি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া কয়েকটি নির্বাচন স্থগিত করা হয়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৮৫ (১১ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতাসহ), বিএনপি ১১, জাতীয় পার্টি এক, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ এক ও স্বতন্ত্ররা ৩২টিতে মেয়র পদে জয় পান। ২৩০ পৌরসভায় ৭৭ লাখ ২৪ হাজার ৯১২ জন ভোটারের মধ্যে মেয়র পদে ৪৯ লাখ ৭৩ হাজার ২৭ ভোট পড়ে। ভোট পড়ার হার ৬৪.৩৭ শতাংশ।

পাঁচ ধাপের নির্বাচনে মেয়র পদে সংগ্রহীত ভোটের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থীরা নৌকা প্রতীকে পেয়েছেন ২৯ লাখ ৭৯ হাজার ৮০৭ ভোট, যা প্রদত্ত ভোটের ৫৯.৯১ শতাংশ। পক্ষান্তরে বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা পেয়েছেন ১০ লাখ ৪৬ হাজার ৩৬ ভোট, যা প্রদত্ত ভোটের ২১.৩ শতাংশ। এছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ অন্যান্য দলের প্রার্থীরা পেয়েছেন ৯ লাখ ৪৭ হাজার ১৮৪ ভোট, প্রদত্ত ভোট ১৯.০৬ শতাংশ।

এর আগে ২০১৫ সালে প্রথম দলীয় প্রতীকে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সময় অনুষ্ঠিত ২৩৫টি পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৫৩.৫৪ শতাংশ ও বিএনপি ২৭.৬৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ওই নির্বাচনে ২৩৫টি পৌরসভার মধ্যে মেয়র পদে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৮২টিতে (সাতজন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়) এবং বিএনপি ২৪টিতে বিজয়ী হয়।

এছাড়া জাতীয় পার্টি থেকে ১ জন এবং স্বতন্ত্র ২৮ জন মেয়র পদে নির্বাচিত হন। নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৭৩.৯২ শতাংশ। এ হিসাবে এবার বিএনপির ভোট ও মেয়র দুই-ই কমেছে। বেড়েছে আওয়ামী লীগের। ওই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ২ জন এবং বিএনপির ৩৫ জন মেয়র প্রার্থী জামানত হারান। এবার ২০২১ সালে আওয়ামী লীগের তিনজন এবং বিএনপির ৯৩ জন জামানত হারিয়েছেন।

পরপর দুই নির্বাচনের ফল ভোটারদের মতামত নয় বলে মনে করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, সরকারি দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে মনোনয়ন পাওয়ার দিকেই বেশি আগ্রহ দেখা গেছে। আর নির্বাচনের নামে প্রহসনের খেলা হয়েছে। তিনি বলেন, নির্বাচনটি একচেটিয়া ছিল। নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সবই নিয়ন্ত্রিত ছিল। নির্বাচনে ইসি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছে। তারা অনিয়ম ও সহিংস ঘটনায় ব্যবস্থা নেয়নি।

এবার প্রত্যেক ধাপের নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হলেও পাঁচ ধাপের তিন ধাপেই ভোটের দিন নির্বাচনি সহিংসতায় মানুষের প্রাণহানি ঘটে। কয়েকটি ঘটনায় তদন্ত ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপই নেয়নি সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানটি। তবে ওইসব ঘটনাকে বিক্ষিপ্ত আখ্যায়িত করে সুষ্ঠু নির্বাচন হয়েছে বলে প্রত্যেক নির্বাচনের পর দাবি করে আসছে ইসি।

পাঁচ ধাপে দুই দলের ভোট :

গত ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের ২৪টি পৌরসভার মধ্যে ১৯টিতে আওয়ামী লীগ, দুটিতে বিএনপি এবং তিনটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মেয়র নির্বাচিত হন। ওই ধাপে মেয়র পদে প্রাপ্ত মোট ভোটের ৬৪.০৬ শতাংশ পান ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা। অপরদিকে বিএনপির প্রার্থীরা পান ১৩.৩৯ শতাংশ ভোট। ভোট পড়ার হার ছিল ৬৫.২৫ ভাগ। প্রথম ধাপে বিএনপির ১২ জন প্রার্থী তাদের জামানত রক্ষা করতে পারেননি।

১৬ জানুয়ারি দ্বিতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত ৬০টি পৌরসভা নির্বাচনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৪জনসহ আওয়ামী লীগের ৪৬ জন, দলটির বিদ্রোহী ৪জন এবং বিএনপির ৪জন ও বিএনপির বিদ্রোহী ২ জন মেয়র নির্বাচিত হন। এছাড়া জাতীয় পার্টির ১জন ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের ১জন মেয়র নির্বাচিত হন। এ ধাপে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা মেয়র পদে ৬০. ০৩ শতাংশ ও বিএনপির প্রার্থীরা ১৭. ৯১ শতাংশ ভোট পান। ভোট পড়ার হার ছিল ৬৩.৬৭ শতাংশ। দ্বিতীয় ধাপে বিএনপির ২৯ জন জামানত হারিয়েছেন।

তৃতীয় ধাপে ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ৬৩টি পৌরসভার মধ্যে মাত্র ৩টিতে মেয়র পদে জয় পান বিএনপির প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীরা ৪৬টিতে জয় পান। স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছেন ১৪টিতে; যাদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী। এ ধাপে মেয়র পদে প্রাপ্ত ভোটের ৬১.৮৫ শতাংশ আওয়ামী লীগ ও ১৯.৭৫ শতাংশ বিএনপির প্রার্থীরা পেয়েছেন। এ ধাপে বিএনপির ২৭ জন এবং আওয়ামী লীগের ২জন জামানত হারিয়েছেন। ভোট পড়ার হার ৭০.৪২ শতাংশ।

চতুর্থ ধাপে ৫২ পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৬টি, বিএনপি ১টি ও স্বতন্ত্ররা ৫টিতে জয় পান। মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পেয়েছেন প্রদত্ত ভোটের ৫৭. ৬২ শতাংশ। অপরদিকে বিএনপির প্রার্থীরা পেয়েছেন ১৬.৪৪ শতাংশ ভোট। এ নির্বাচনে বিএনপির ২৩ জন মেয়র প্রার্থী তাদের জামানত হারিয়েছেন। ভোট পড়ার হার ৬৫.৩৩ শতাংশ।

সর্বশেষ পঞ্চম ধাপে ৩১টি পৌরসভার মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮টি, বিএনপি ১টি ও স্বতন্ত্ররা ২টিতে জয় পান। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীরা ৫৭. ৫৮ শতাংশ ও বিএনপির প্রার্থীরা ২১.৩৭ শতাংশ ভোট পেয়েছেন। ভোট পড়ার হার ৫৮.৬৭ শতাংশ। এ ধাপে বিএনপির ১২ জন জামানত হারিয়েছেন।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Telegram
WhatsApp
Email
Print