
প্রভাতী ডেস্ক : সিলেটের ঐতিহাসিক এমসি (মুরারীচাঁদ) কলেজ ছাত্রাবাসে গৃহবধূকে গণধর্ষণের মামলায় প্রধান আসামি সাইফুরসহ ৩ জনের ৫ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। সোমবার (২৮শে সেপ্টেম্বর) পুলিশি পাহারার প্রিজন ভ্যানে মামলার প্রধান আসামি ছাত্রলীগ নেতা সাইফুর রহমান ও অর্জুন লস্কর এবং দুপুরে রবিউল ইসলামকে সিলেট মহানগর হাকিম-২ আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও এসএমপির শাহপরান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য আসামিদের ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। আদালত সাইফুর রহমানসহ প্রত্যেকের পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। আসামিদের পক্ষে কোনো আইনজীবী আদালতে দাঁড়াননি। আইনজীবীরা বলছেন, স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে গণধর্ষণের মতো জঘন্যতম ঘটনা সমাজের মানুষকে নাড়া দিয়েছে। তাই ঘৃণা ও নৈতিক অবস্থান থেকেই তারা আসামিপক্ষে দাঁড়াননি।
রোববার রাতে আরো দু’জনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। তারা হলেন- ছাত্রলীগ নেতা রাজন মিয়া এবং মো. আইনুদ্দিন। একই রাতে গ্রেফতার হওয়া ছাত্রলীগ নেতা মাহবুবুর রহমান রনির দেয়া তথ্য অনুযায়ী তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ নিয়ে গণধর্ষণের মামলায় ৬জনকে গ্রেফতার করা হল।
এদিকে সোমবারও রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে এমসি কলেজে গণধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে বিভিন্ন কর্মসূচী অব্যাহত ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী, ছাত্রসংগঠন এবং নানা পেশার মানুষ মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। এসব কর্মসূচিতে বক্তারা ধর্ষকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন। দোষীদের বিচার না হওয়ার কারণেই মূলত ধর্ষণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে বলেও মন্তব্য করেন তারা। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ধর্ষণের ঘটনায় নিন্দার ঝড় বইছে।
রাষ্ট্রপক্ষের এপিপি অ্যাডভোকেট খোকন কুমার দত্ত জানান, আদালতে রিমান্ড শুনানিকালে আসামিদের পক্ষে কোনো আইনজীবী উকালত নামা দাখিল করেননি। তবে বাদীপক্ষের হয়ে বেশ কয়েকজন আইনজীবী শুনানিকালে উপস্থিত ছিলেন। আদালত আসামিদের বক্তব্য শুনতে চাইলে তারা আদালতকে জানায়, ছাত্রাবাসে ঘটে যাওয়া ঘটনার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তারা অপরাধ করেনি। এ ঘটনা ঘটিয়েছে রাজন, তারেক ও আইনুদ্দিন (রাজন ও আইনুদ্দিন গ্রেফতার)। পরে আদালত তাদের প্রত্যেকের পাঁচ দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আসামিপক্ষে আদালতে না দাঁড়ানো প্রসঙ্গে আইনজীবী দেবব্রত চৌধুরী লিটন বলেন, এটি একটি জঘন্যতম ও নির্মম ঘটনা। যা সমাজের মানুষকে নাড়া দিয়েছে এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। তাই নৈতিক অবস্থান থেকেই আমরা আইনজীবীরা আসামিপক্ষে দাঁড়াইনি এবং তাদের জামিনে কেউ আবেদন করেনি।
সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এটিএম ফয়েজ বলেন, আইনজীবীদের এ সিদ্ধান্ত ব্যক্তিগত। ঘৃণা প্রকাশের জন্যই স্বপ্রণোদিত হয়ে কোনো আইনজীবী আসামিপক্ষে মামলা পরিচালনা করতে যাননি। তবে সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতি আনুষ্ঠানিকভাবে এ সিদ্ধান্ত নেয়নি।
এদিকে রোববার রাতে হবিগঞ্জ সদর থানা এলাকা থেকে গণধর্ষণ মামলার ৩নং আসামি ছাত্রলীগ নেতা মাহবুবুর রহমান রনিকে (২৮) আটক করে র্যাব-৯ এর শ্রীমঙ্গল ক্যাম্প। পরে রনির দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাতেই ছাত্রলীগ নেতা রাজন মিয়া ও মো. আইনুদ্দিনকে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করা হয়।
চুনারুঘাট সীমান্তে কড়া নজরদারি : চুনারুঘাট প্রতিনিধি জানান, এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের ঘটনায় হবিগঞ্জের মাধবপুর সীমান্ত দিয়ে পালানোর চেষ্টা করেছিল অন্যতম আসামি অর্জুন লস্কর। যদিও তার শেষ রক্ষা হয়নি। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সিলেট গোয়েন্দা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। অন্য কোনো আসামি যাতে দেশ থেকে পালাতে না পারে সে জন্য চুনারুঘাট ও মাধবপুর সীমান্তে আরও কড়া নজরদারি রাখা হয়েছে।
এ ব্যাপারে চুনারুঘাট থানার পরিদর্শক (ওসি তদন্ত) চম্পক ধাম বলেন, আমাদের পার্শ্ববর্তী উপজেলা মাধবপুর সীমান্ত দিয়ে এক আসামি পালানোর চেষ্টা করেছিল। তাই আমরা চুনারুঘাট সীমান্তে নজরদারি বাড়িয়েছি। পুলিশের পাশাপাশি বিট পুলিশ ও নিজস্ব সোর্স সীমান্তে কাজ করছে।
জানা গেছে, ধর্ষণের শিকার তরুণীর বাড়ি সিলেটের দক্ষিণ সুরমায়। তিনি শুক্রবার বিকেলে স্বামীসহ নিজেদের গাড়িতে করে শহরের টিলাগড় এলাকায় এমসি কলেজে বেড়াতে যান। গাড়ি চালাচ্ছিলেন তার স্বামী। সন্ধ্যার পর কলেজের প্রধান ফটকের সামনে গাড়ি রেখে তারা একটি দোকানে কেনাকাটা করেন। পরে গাড়িতে ফিরে তারা গল্প করছিলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে কয়েকজন যুবক তাদের গাড়ির কাছে আসে। তারা তরুণীকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে স্বামী বাধা দেন, তখন তাকে মারধর করে দুর্বৃত্তরা। একপর্যায়ে তারা জোরপূর্বক গাড়িতে উঠে স্বামী-স্ত্রীকে নিয়ে পাশের বালুচর এলাকায় এমসি কলেজ ছাত্রাবাসের অভ্যন্তরে নিয়ে আসে। সেখানে ছাত্রাবাসের ৭ নম্বর ব্লকের সামনে গিয়ে স্বামীকে গাড়ি থেকে বের করে আটকে রাখে এবং স্ত্রীকে গাড়িতে ধর্ষণ করে। প্রায় এক ঘণ্টা পর স্বামীকে ছেড়ে দিলে তিনি ৭ নম্বর ব্লকের সামনে স্ত্রীকে বিধ্বস্ত অবস্থায় পান।
এ সময় তিনি টিলাগড়ের যুবলীগের এক নেতাকে মোবাইল ফোনে ঘটনার কথা জানান। যিনি একসময় জেলা ছাত্রলীগের পদধারী নেতা ছিলেন। ওই নেতা টিলাগড়ের আরেকটি বলয়ের প্রভাবশালী নেতা। তিনি আসার পর ধর্ষণকারীরা চলে যায়।
এ সময় ধর্ষণকারীদের বলয়ের নেতারা ঘটনা চাপা দিতে আপোস-রফার চেষ্টা চালান। দীর্ঘসময় চেষ্টা চালানোর পাশাপাশি ভয়ভীতিও প্রদর্শন করা হয়। কিন্তু ধর্ষিতার স্বামী এবং ওই নেতা বিষয়টি মানেননি।
পরে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। রাত সাড়ে ১০টার দিকে মহানগর পুলিশের শাহ পরান থানা-পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থলে আসে। পুলিশ ধর্ষণের শিকার তরুণীকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) পাঠায়। এ সময় ধর্ষকদের ফেলে যাওয়া একটি মোটরসাইকেল জব্দ এবং ওই দম্পতির ব্যবহৃত প্রাইভেট কার উদ্ধার করা হয়।