
বিশেষ প্রতিনিধি : বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সকল সচেতন জনগণ এবং প্রশাসনের সব মহল খুবই ব্যস্ত সময় পার করছেন। কিন্তু এমন দূর্যোগ মূহূর্তেও বন্ধ হচ্ছে না খুন-খারাবির মত জঘন্য ঘটনা। সম্প্রতি ৩৪ ঘন্টার ব্যবধানে পৃথক ২টি ঘটনায় চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে ঝড়ে গেল ৩টি তাজা প্রাণ। এই ৩টি খুন নিয়ে বাঁশখালীর জনমনে বিরাজ করছে আতঙ্ক।
উপজেলার ইলশা গ্রামে পৃথক ইটভাটার দুই মালিক মো. নুরুল আবছার ও দিদারুল আলমের মধ্যে ব্যবসায়িক ও আধিপত্যের দ্বন্দ্ব রয়েছে। সেই দ্বন্দ্বের জেরে দুই মালিকের অনুসারীদের মধ্যে মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে গোলাগুলি হয়। এসময় গুলিবিদ্ধ হন হাফেজ খালেদ এবং হাফেজ ইব্রাহিম। খালেদ ঘটনাস্থলে মারা যান। ইব্রাহিমকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে বুধবার সন্ধ্যায় তিনিও মারা যান।
সাধনপুর এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে খুনের ঘটনা সম্পর্কে বাঁশখালী থানা ও স্থানীয় ১টি সূত্রে জানা যায়, নিহত জহিরুল হকের দুঃসম্পর্কীয় ভাগিনা মাহমুদুল ইসলামের সাথে তার অন্যান্য ভাইদের মধ্যে জায়গা জমি নিয়ে বিরোধ ছিল। মাহমুদুল ইসলামের নতুন বাড়ির পাশে তার অন্যান্য ভাইদের জায়গাও রয়েছে ।বাড়ির পাশে ডুবা ভরাট করার বাহানায় তার অন্যান্য ভাইদের জায়গা থেকে পুকুর খননের ন্যায় মাটি তুলে ফেলে। এই কথা তার অন্য ভাইয়েরা জানতে পারিলে ১১ই মে সন্ধ্যা আনুমানিক সাড়ে সাতটার দিকে মাহমুদুল ইসলামের বাড়ীর সামনে গিয়ে ,মাটি খননের কারণ জানতে চাইলে , মাহমুদুল ইসলাম ক্ষিপ্ত হয়ে গালাগাল দিতে থাকে। এক পর্যায়ে তার ছোট ভাই তার বাড়ীর টিনের চাল’র উপর লাঠি দিয়ে বাড়ি মারে। এক পর্যায়ে কথা কাটাকাটি করে তারা চলে আসার সময়, নিহত জহিরের ভাগিনা আমির হোসেন মিন্টু ও তার বড় ভাই জমির উদ্দিন দু’জন হাতে লম্বা দা -কিরিচ নিয়ে মাহমুদুল ইসলামের পক্ষ নিয়ে তার অন্যান্য ভাইদের উপর আক্রমণ করে। এক পর্যায়ে স্থানীয় জনসাধারণ তাদেরকে শান্ত করে পাঠিয়ে দেয়। এর মধ্যে নিহত জহিরের ভাগিনারা তার মামাদেরকে খবর দেয় যে, মাহমুদুল ইসলামের অন্যান্য ভাইয়েরা তাদেরকে আক্রমন করেছে। এই খবর শুনে দক্ষিণ সাধনপুর হতে নিহত জহির, তার ভাই ও ভাতিজাসহ অনেক লোকজন হাতে দা-কিরিচ ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মুর্শিদ আহসান পীর মাজার গেইটের সামনে রাস্তায় তাদের উপর আক্রমণ করে এবং মাহমুদুল ইসলামের ভাইদের বাড়িতে হামলা করে। এই ঘটনায় স্থানীয়রা এগিয়ে আসলে তারা পালিয়ে যায়। পরে ঘটনাস্থলে পুলিশ এসে উভয়পক্ষকে শান্ত থাকার অনুরোধ করে। এই ঘটনার জের ধরে মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৭টায় অতর্কিত ছুরিকাঘাত করে জহিরুল ইসলামকে গুরুতর আহত করে মাহমুদুল ইসলামের প্রতিপক্ষের লোকজন। তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার সময় তার মৃত্যু হয়।

এলাকার স্থানীয় অপর একটি সূত্রে জানা যায়, সোমবার রাতে মাহমুদুল ইসলামের সাথে তার ভাইদের মারামারির ঘটনায় চড়াও হয়েছিলেন তার মামা জহিরুল হক (নিহত)। পরদিন মঙ্গলবার সকাল ৮টার দিকে মো: আনিছ (পেশায় ট্রাকচালক) গাড়ী নিয়ে বের হয়ে জহিরুল হকের বাড়ীর সামনে পৌঁছলে দিদার, জামাল, হাসান, আমির হোসেন মিন্টু, জমির উদ্দিন, রবিউল এবং জহিরুল হক ,আনিছের উপর হামলা চালিয়ে তাকে উপর্যপুরি ছুরিকাঘাত করে হাতের কব্জি এবং মাথায় গভীর কাটা জখম করে মুমূর্ষু অবস্থায় রাস্তায় ফেলে রাখে। আনিছের উপর হামলার ঘটনা জানতে পেরে ,তার বাবা ও ছোট ভাই ইলিয়াছ ছুটে আসে। জহিরুল এবং আমির হোসেন মিন্টু ইলিয়াছকে আটকে রাখে। এমন সময়ে জহিরুলের বড় ভাই দিদারের স্ত্রী জোহরা ভেতর থেকে লম্বা ছুরি নিয়ে এসে ,ইলিয়াছকে আঘাত করার সময় ইলিয়াছ সরে গেলে,দূর্ভাগ্যক্রমে ছুরি জহিরের পেটে ঢুকে যায়। জহিরকে তার প্রতিবেশীরা গুনাগরীর একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে প্রেরণ করেন। এদিকে খবর ছড়িয়ে পড়ে, আহত আনিছ মারা গেছেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে আনিছের প্রতিবেশী লোকজন জহিরুল হককে অ্যাম্বুলেন্সে করে চমেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় দক্ষিণ সাধনপুরের প্রধান সড়কের ওপর পৌঁছালে অ্যাম্বুলেন্সের গতি রোধ করে আটকে রাখে। স্থানীয় জনসাধারণ এগিয়ে আসলে তারা অ্যাম্বুলেন্সটি ছেড়ে দেয়।

এলাকাবাসী জানায়, বর্তমানে আনিছ মুমূর্ষু অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তার মাথা, হাতসহ শরীরের অনেক অংশে গুরুতর জখম রয়েছে। জহিরুল হত্যায় ইলিয়াস এবং আনিছকে প্রধান আসামী করায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন এলাকাবাসী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের দাবী আর যাই হোক কিংবা জহিরকে যারা হত্যা করুক না কেন, ইলিয়াছ এবং আনিছ এই হত্যাকান্ডে জড়িত নয়। জহির হত্যা নিয়ে যেসব সংবাদ প্রকাশ করা হয়েছে সেখানে কোথাও ইলিয়াছ এবং আনিছের নাম নেই। তাহলে মামলায় ইলিয়াছ এবং আনিছকে কেন প্রধান আসামী করা হলো? আমরা চাই এসব খুন-খারাবী বন্ধ হউক, এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হউক।
ইলিয়াছ এবং আনিছের বাবা ফজল প্রশ্ন করে বলেন, আমার ছেলেরা যদি জহিরকে হত্যা করে তাহলে আনিছ আজ মৃত্যু শয্যায় কেন? ইলিয়াসও গুরুতর আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছে। তারা আমিসহ আমার ২ ছেলেকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। আনিছ শঙ্কামুক্ত নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন ,আমার ছেলে আনিছ যেকোন সময় মারা যেতে পারে।
এই ব্যাপারে জানতে চাইলে বাঁশখালী থানার অফিসার ইনচার্জ রেজাউল করিম মজুমদার বলেন, জহিরুল হক হত্যা মামলায় ২৩ জনকে অভিযুক্ত করে এজাহার দিয়েছেন তার স্ত্রী। ২নং আসামি আনিছকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আটক করে সেখানে তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। অন্যান্য আসামীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।