এম. জিয়াউল হক: করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সারাদেশ লকডাউন ঘোষণা করেছে সরকার। লকডাউনের কারণে দিনমজুর লোকজন কর্মক্ষম হওয়ায় সরকার ত্রাণ প্রদানের ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু সরকারী যেই ত্রাণ বিতরণ করতেছে তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এই কারণে দিনমজুর লোকজন অত্যান্ত মানবেতর জীবনযাপন করতেছে। তাদের জীবন কাটছে অর্ধাহারে এবং অনাহারে।
এমনই একটি এলাকায় প্রতিনিয়ত ক্ষুধার কান্না শুনা যায়, সেই এলাকাটি হলো চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড থানার জঙ্গল ছলিমপুরের ছিন্নমূল বাস্তুহারা। এই এলাকাটি একটি জনবহুল এলাকা। এই এলাকায় সরকারি হিসেবে ২৪ হাজার পরিবারের বসবাস হলেও বেসরকারি হিসেবে প্রায় ৩০ হাজার পরিবারের বসবাস। এই এলাকার ৮০ ভাগ লোকই দিনমজুর অর্থাৎ সিএনজি চালক, বাস চালক-হেল্পার, ঠেলা গাড়ী চালক এবং কাঠমিস্ত্রী ও রাজমিস্ত্রীসহ বিভিন্ন শ্রমজীবী। এসব লোকজন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দু’বেলা দু’মুঠো ডাল-ভাত খেতে পারলেও লকডাউনের কারণে তারা সম্পূর্ণ কর্মক্ষম হওয়ায় এখন অনাহারে দিনযাপন করতেছে। কেউ কেউ ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে ১/২ বেলা খাবার জোগাড় করার চেষ্টা করতেছে। খেতে না পারার কারণে এসব দরিদ্র পরিবার থেকে প্রতিনিয়ত শিশুদের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসতেছে।
উক্ত এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দরিদ্র লোকজন তাদের পরিবারের জন্য একবেলা আহার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। ক্ষুধার্ত লোকজন জড়ো হয়ে বলতে থাকেন তারা খাবার চায়, বাঁচতে চায়। ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে তারা বিভিন্ন শাক-সব্জি রান্না করে খাচ্ছেন। কয়েকজন মহিলা বলেন, তারা ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে ক্ষুধার্ত সন্তানের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন। নিজেদেরকে এই দেশের নাগরিক উল্লেখ করে তারা সরকারের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন রেখে বলেন, লাখ লাখ রোহিঙ্গা বছরের পর বছর এদেশে লালন -পালন হতে পারলে সরকারী ব্যবস্থাপনায় তারা এক মাসও চলতে পারবে না কেন? সরকারের কাছে তাদের বিনীত অনুরোধ তারা শুধু ২বেলা ডাল-ভাত চায়। তাদের এই চাহিদা পূরণ করলে সরকারি নির্দেশ শতভাগ পালন করে যতদিন প্রয়োজন ঘরেই থাকবেন। অন্যথায় ক্ষুধার যন্ত্রণায় রাস্তায় নামতে বাধ্য হবেন।
জনগণের এমন দূর্দশা সম্পর্কে ১ নং সাংগঠনিক ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি মো: ইসরাফিল বলেন, অতিরিক্ত পরিবারের কথা বাদ দিলেও সরকারি হিসেবে এই এলাকায় ২৪ হাজার পরিবারের বসবাস। এরমধ্যে প্রায় ২০ হাজার পরিবার হতদরিদ্র। এই পর্যন্ত ২৫০-৩০০ পরিবারের জন্য সরকারি খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এলাকায় ঢুকলে ক্ষুধার্ত মানুষের আহাজারি সহ্য হয়না উল্লেখ করে তিনি বলেন, অতি দ্রুত পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবারের ব্যবস্থা করা না হলে অনেক লোক অনাহারে মারা যাবে। এতগুলো লোকজনের জন্য চিকিৎসা সেবার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি অত্র এলাকায় একটি কমিউনিটি ক্লিনিকের ব্যবস্থা করার জন্যও সরকারের নিকট জোর দাবি জানান।
‘ছিন্নমূল বস্তিবাসী বাস্তুহারা বহুমুখী সমবায় সমিতি লিঃ’ এর সাধারণ সম্পাদক কাজী মশিউর রহমান বলেন, আমাদের এলাকার লোকজন সম্পর্কে সবাই অবগত আছেন। অত্র এলাকায় প্রায় ৩০ হাজার পরিবার থাকা সত্ত্বেও চেয়ারম্যান মহোদয় মাত্র ১৩০ টি প্যাকেট এবং ১২ বস্তা চাউল প্রদান করেছেন যা খুবই দুঃখজনক। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, এই সামান্য খাদ্য সামগ্রী কয় পরিবারকে দিব? তিনি বলেন, আমার সাধ্যমত ব্যক্তিগত তরফে এবং বিত্তশালী লোকজনের নিকট থেকে খাদ্য সামগ্রী সংগ্রহ করে অনেক পরিবারকে দিয়েছি। এমতাবস্থায় এলাকার দরিদ্র লোকজনকে ভিজিএফ কার্ডের আওতায় আনতে হবে, পর্যাপ্ত খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করতে হবে। অন্যথায় ক্ষুধার যন্ত্রণায় এই শান্তশিষ্ট-শৃঙ্খল মানুষেরাও অশান্ত হয়ে রাস্তায় নামতে বাধ্য হবে।
ইউপি সদস্য (১নং ওয়ার্ড) মো: গোলাম গফুর বলেন, আমার এলাকার লোকজন খুবই শৃঙ্খল। সরকার সবাইকে ঘরে থাকার জন্য নির্দেশ প্রদানের পর থেকে অনেক লোক অনাহারে দিনযাপন করার পরেও কেউ ১দিনের জন্যও ঘর থেকে বের হন নি। কিন্তু তাদের জন্য আমরা ২বেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারতেছিনা সেটা অত্যান্ত দুঃখজনক। অনাহারী মানুষের কথা বিবেচনা করে দ্রুত পর্যাপ্ত খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করার জন্য টিএনও মহোদয়ের প্রতি বিনীত অনুরোধ জানান তিনি।
ছিন্নমূলের দরিদ্র মানুষের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্রাণ বিতরণ না করার বিষয়ে জানতে চাইলে ১০ নং জঙ্গল ছলিমপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সালাহউদ্দিন আজিজ বলেন তাঁর এলাকায় ৩লাখ লোকের বসবাস, ৬০ হাজার ভোটার। এত বড় এলাকায় ত্রাণ সামগ্রী সবাইকে সমানভাবে বন্টন করা খুবই কঠিন। সরকারি ত্রাণ ছাড়াও নিজস্ব তহবিল গঠন করেও ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন একটি ইউনিয়নের জন্য যা বরাদ্দ দেয়া হয় তা দিয়ে আমার ইউনিয়নের ২০ ভাগ লোককেও দেয়া যেতো না যদি আমার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে না দিতাম। অত্র এলাকার মেম্বার গোলাম গফুর কোন প্রকার সহযোগিতা করতেছেন না, তিনি ৩ বছর ধরে পরিষদেও আসেন না। এরপরেও আওয়ামীলীগ নেতা ইসরাফিল এবং মশিউর সাহেবকে নিয়ে ছিন্নমূলের লোকজনকে যথাসাধ্য ত্রাণ বিতরণ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন মশিউর রহমান নিজেও বিভিন্ন দিক থেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ জোগাড় করে দরিদ্র লোকজনকে দিচ্ছেন। উক্ত এলাকার দরিদ্র লোকজনের জন্য প্রথমে নিজের উদ্যোগে দেড় টন চাল প্রদান করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। এরপরে টিএনও মহোদয়ের নির্দেশে ২৫০- ৩০০ পরিবারের জন্য খাদ্য সামগ্রী সরবরাহ করা হয়েছে, আগামীকাল আবারো ১০০ পরিবারকে দেওয়া হবে। এতোগুলো পরিবারের মধ্যে ১০০ পরিবারকে ত্রাণ দিলে বাকীরা কি করবে এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন সরকার তো আর শুধু সীতাকুণ্ড নিয়ে ভাবতে পারতেছেন না, সরকারকে সারাদেশ নিয়ে ভাবতে হচ্ছে।