
প্রভাতী ডেস্ক: আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু যে লক্ষ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন, তা বাস্তবায়নই এখন আমাদের মূল লক্ষ্য। আমাদের এখন একমাত্র লক্ষ্য- আরো সামনে এগিয়ে যাওয়া, মানুষের অথনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ করা।
শনিবার আওয়ামী লীগের দুই দিনব্যাপী জাতীয় কাউন্সিলের উদ্বোধনী বক্তব্যে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দলের ২১তম ত্রি-বার্ষিক জাতীয় সম্মেলনে তিনি আরো বলেন, আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে গত ৭০ বছরে নানা চেষ্টা ও ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগের ওপর আঘাত এসেছে বারবার। জাতির পিতাকেও কতবার হয়রানি করা হয়েছে, মিথ্যা মামলা হয়েছে, ফাঁসির আদেশ হয়েছে। তারপরেও তিনি সততার সঙ্গে এগিয়ে গিয়েছিলেন বলেই বাঙালি একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছে। তাই যিনি ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, তিনিই সফল হবেন। আর এ কাজটা আওয়ামী লীগই সবচেয়ে বেশি করেছে। এর জন্যই জনগণ কিছু পেয়েছে।
নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে দেশকে ভালোবেসে রাজনীতি করতে নেতাকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। দলীয় নেতাকর্মীদের রাজনীতির মাহাত্ম্য তুলে ধরতে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন- ‘নীতিবিহীন নেতা নিয়ে অগ্রসর হলে সাময়িকভাবে কিছু ফল পাওয়া যায়। কিন্তু সংগ্রামের সময় তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না।’
শেখ হাসিনা বলেন, এটাই হচ্ছে সব থেকে বড় বাস্তবতা। যে কোনো রাজনৈতিক নেতার জীবনে নীতি-আদর্শ সব থেকে বড়, আর সেই আদর্শের জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে সদা প্রস্তুত থাকার কথা। যিনি প্রস্তুত থাকতে পারেন, ত্যাগ স্বীকার করতে পারেন, তিনি সফল হতে পারেন। দেশকে কিছু দিতে পারেন। জাতিকে কিছু দিতে পারেন।
বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, বারবার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা আত্মত্যাগ করেছে এবং তারই ফসল বাংলাদেশের জনগণ আজ পেয়েছে। আজকের বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে সমৃদ্ধির পথে। যে বাংলাদেশের স্বপ্ন জাতির পিতা দেখেছিলেন। সেটাই আমাদের লক্ষ্য। আমরা সেটাই করতে চাই। সোনার বাংলার যে স্বপ্ন বঙ্গবন্ধু দেখতেন, তা বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ত্যাগের মানসিকতা নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।
তিনি বলেন, ইয়াহিয়া, আইয়ুব খান, জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া- যে যখন ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন ও ধ্বংস করতে বারবার আঘাত হেনেছে, নানা ষড়যন্ত্র করেছে। এতে আওয়ামী লীগের সাময়িক কিছু ক্ষতি করতে পারলেও জাতির পিতার হাতে গড়া এ সংগঠনকে কেউ ধ্বংস বা নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। বরং সব আঘাত ও ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই আওয়ামী লীগ এখন দেশের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী সংগঠন।
৩৮ বছর দলটির সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেন, মাত্র এক দশকেই ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়, আওয়ামী লীগই এ দেশের মানুষকে কিছু দিতে পেরেছে। বাংলাদেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। দেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে আর কেউ ছিনিমিনি খেলতে পারবে না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলেই দেশের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়।
এর আগে বেলা ৩টায় আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাস্থলে উপস্থিত হন। এরপর কাউন্সিল উদ্বোধন করা হয় উৎসবমুখর পরিবেশে। সমবেত জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সভাপতি জাতীয় পতাকা এবং সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের দলীয় পতাকা উত্তোলন করেন।
মঞ্চের পাশে আওয়ামী লীগের ৭৮ জেলা ও মহানগর কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা দলীয় ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। পতাকা উত্তোলন শেষে আওয়ামী লীগ সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক এবং জেলা-মহানগর কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা বেলুন ও শান্তির প্রতীক পায়রা উড়িয়ে দেন। এরপর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মঞ্চে ওঠেন। এ সময় তিনি হাত নেড়ে উপস্থিত নেতাকর্মীদের শুভেচ্ছা জানান।
প্রধানমন্ত্রী আসন গ্রহণ করার পর শুরু হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের আরেকটি নাম মুজিবুর’ দিয়ে শুরু হয় সঙ্গীতানুষ্ঠান। সেখানে মনোজ্ঞ কোরিওগ্রাফি করা হয়। এরপর ‘বাংলার হিন্দু, বাংলার বৌদ্ধ, বাংলার খ্রিস্টান, বাংলার মুসলমান’, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’সহ বেশ কয়েকটি দেশাত্মবোধক গানের তালে নৃত্য, সঙ্গে ডিজিটাল পর্দায় ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধসহ বাংলাদেশ এবং আওয়ামী লীগের ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং বর্তমান সরকারের উন্নয়ন ও সাফল্য তুলে ধরা হয়। ৩টা ৫০ মিনিট পর্যন্ত অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এ অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করেন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসিম কুমার উকিল।
৩টা ৫২ মিনিটে কাউন্সিলের মূল পর্ব শুরু হয়। আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ এবং উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আমিনুল ইসলাম আমিন সঞ্চালনা করেন।
শুরুতে পবিত্র কোরআন থেকে তেলাওয়াত করেন কারী মাওলানা আবদুর রহমান, গীতা পাঠ করেন বাবু ধীমান দাস, ত্রিপিটক থেকে পাঠ করেন ভগন্দ সুনন্দ প্রিয় ভিক্ষু ও বাইবেল থেকে পাঠ করেন উইলিয়াম প্রলয় সমাদ্দার বাপ্পী।
দলের শোক প্রস্তাব পাঠ করেন আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ। এতে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যসহ ১৫ আগস্টের ঘৃণ্য হামলায় নিহতদের স্মরণ করা হয়।
এছাড়া জাতীয় চার নেতা, মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ, গ্রেনেড হামলায় নিহত, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ আওয়ামী লীগের নিহত জতীয় নেতা ও তাদের পরিবারের সদস্যদের স্মরণ করা হয়। স্মরণ করা হয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের। পরে নিহতদের স্মরণে এক মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করা হয়। অভ্যর্থনা উপকমিটির আহ্বায়ক মোহাম্মদ নাসিমের বক্তব্যের পর সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্ট উপস্থাপন করেন ওবায়দুল কাদের।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের শেষে সম্মেলন শনিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত মুলতবি ঘোষণা করা হয়। রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনের মাঠে নির্মিত মঞ্চে সকাল ১০টায় দ্বিতীয় কাউন্সিল অধিবেশনেই আগামী তিন বছরের জন্য নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা দেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে আগত প্রায় ৫০ হাজার নেতাকর্মী ও আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যাহ্নভোজে আপ্যায়িত করা হয়।
টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার কারণেই দেশ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ থেকে ২০১৯ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। এই এক দশকেই বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, দারিদ্র্যের হার ২০ দশমিক ৫ ভাগে নামিয়ে এনেছি। জাতির পিতা যে স্বল্পোন্নত দেশ রেখে গিয়েছিলেন, আজ আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। এটা ধরে রাখতে হবে। আমাদের লক্ষ্য সামনে আরও এগিয়ে যাওয়া।
পঁচাত্তরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পরবর্তী প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, রাজনীতি আমার জন্য নতুন কিছু ছিল না। স্কুল থেকে রাজনীতি করতাম। দেয়াল টপকে মিছিলে যেতাম, আন্দোলনে যোগ দিতাম। কলেজ জীবনেও রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম, কলেজে ভিপিও নির্বাচিত হয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও সক্রিয় আন্দোলন করেছি, কিন্তু কখনো ভাবিনি এত বড় সংগঠন আওয়ামী লীগের গুরুদায়িত্ব আমাকে নিতে হবে, এত বড় দায়িত্ব আমি নিতে পারব।
আবেগজড়িত কণ্ঠে শেখ হাসিনা বলেন, পঁচাত্তরে বাবা-মা সবাইকে হারিয়েছি। ছয়টি বছর আমাকে দেশে আসতে দেয়নি অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান। রিফিউজি ছিলাম আমরা দুই বোন। ১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগ আমার অবর্তমানে আমাকে সভাপতি নির্বাচিত করেছিল। আওয়ামী লীগের ওই সিদ্ধান্তে জনগণের সাড়া ছিল। সে কারণেই নেতাকর্মীদের আহ্বানে দেশে ফিরে এসেছিলাম।
ওই সময়ের বৈরী অবস্থার কথা তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের হাতে মুক্তি দিতে ইনডেমনিটি জারি, দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা, যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের রাজনীতি করার সুযোগ, বঙ্গবন্ধুর খুনিকে রাষ্ট্রপতির পদপ্রার্থী করা- এমন বৈরী পরিবেশে দেশে ফিরে এসে দলকে শক্তিশালী করার কাজ করি। তখন আওয়ামী লীগ ছিল ব্রাকেট বন্দি। দলে ভাঙন হয়েছে, আবার নতুনভাবে গড়ে তুলেছি। শত বাধা, ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ আজ দেশের সবচেয়ে বড় ও শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয়েছে।