প্রভাতী ডেস্ক: মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ী ফেরীঘাটে একজন যুগ্ম সচিবের গাড়ির অপেক্ষায় ফেরি পার হতে তিন ঘণ্টা দেরি হওয়ায় অ্যাম্বুলেন্সে থাকা আহত স্কুল ছাত্র তিতাসের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। স্বজনদের অভিযোগ, ঘাটের বিআইডব্লিউটিসি কর্মকর্তা এবং পুলিশসহ সবার কাছে অনুরোধ করার পরেও ওই কর্মকর্তা না আসা পর্যন্ত কাঁঠালবাড়ি ঘাট থেকে ফেরি ছাড়েনি। গত ২৫জুলাই বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে এই ঘটনা ঘটে।
স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৯৯৯ নম্বরে ফোন করে সাহায্য চাওয়া হয়েছিল তবু ফেরি চালু করা যায়নি। পরে প্রায় তিন ঘণ্টা অপেক্ষার পর যুগ্ম সচিবের গাড়ি আসলে “ফেরি কুমিল্লা” যাত্রা শুরু করে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে যায়। নদী পার হওয়ার আগেই রাত সাড়ে ১২টার দিকে মারা যায় তিতাস ঘোষ (১১)। সে নড়াইলের কালিয়া উপজেলার পৌর এলাকার মৃত তাপস ঘোষের ছেলে এবং কালিয়া পাইলট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র ছিল।
খুলনা থেকে লাইফ সাপোর্ট এ্যাম্বুলেন্সে করে তিতাসকে নেওয়া হচ্ছিল ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে। ঢাকায় তার জরুরি অপারেশন হওয়ার কথা ছিল। সেরকম প্রস্তুতিও নিয়ে রাখা হয়েছিল। তাই চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রেখে দ্রুত ঢাকায় পৌঁছাতে অর্ধলাখ টাকায় ভাড়া করা হয় আইসিইউ সংবলিত অ্যাম্বুলেন্স। অ্যাম্বুলেন্সটি ঘাটে এসে থামে রাত ৮টার দিকে।
কিন্তু ঘাটের এক পাশেই তিন ঘণ্টার দেরি সব আশা শেষ করে দেয়। তিতাসের মা সোনা মনি ঘোষ প্রাণান্তকর চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি।
তিতাসের মামা বিজয় ঘোষ (৫০) জানান, রাত সাড়ে ৮টার দিকে মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ী ১নং ফেরি ঘাটে পৌঁছায় অ্যাম্বুলেন্সটি। তখন ‘কুমিল্লা’ নামের ফেরিটি ঘাটেই ছিল। তবে গাড়ি উঠানো হয়নি। প্রায় আধা ঘণ্টা পার হয়ে যায় কিন্তু ফেরির ডালা খুলেনি। একজন যুগ্ম সচিব আসবেন তাই অপেক্ষা করা হচ্ছিল। এই অবস্থায় তিতাসের মা সোনা মনি এবং তিতাসের বড় বোন তনিশা ঘোষ দিশেহারা হয়ে পড়েন। প্রতিকারের জন্য নানা প্রান্তে যোগাযোগ করা হয়। এমনকি অ্যাম্বুলেন্সের রোগীর সাথে থাকা চিকিৎসক ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্রও বিভিন্ন জনের সঙ্গে কথা বলে চেষ্টা চালান। বিষয়টি অ্যাম্বুলেন্স মালিককে অবহিত করা হলে সেখান থেকেও চেষ্টা চালানো হয়। তিতাসের ভগ্নীপতি মহাদেব ঘোষ ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চান। এমনকি ফেরি কর্তৃপক্ষের কাছে ওই কর্মকর্তার ফোন নম্বর চাওয়া হলেও, তা দেওয়া হয়নি।
এসব বিষয়ে কাঁঠালবাড়ি ঘাটে দায়িত্বরত বিআইডব্লিউটিসির ব্যবস্থাপক আব্দুস সালাম জানান, ঘটনার সময় অপারেশনে ছিলেন বিআইডব্লিউটিসির উচ্চমান সহকারী ফিরোজ আলম। পিরোজপুর থেকে যুগ্ম সচিবের গাড়িটি রওনা হবার পর ভাঙ্গার কাছে এসে তিনি ফোন দেন। সে অনুযায়ী দায়িত্বরত ফিরোজ আলমকে অবহিত করি। কিন্তু সেখানে মুমূর্ষু রোগী থাকার বিষয়টি আমার জানা ছিল না।
উচ্চমান সহকারী ফিরোজ আলম জানান, বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ২০ মিনিটের দিকে ফোনটি আসে। সংশ্লিষ্টরা জানায়, যুগ্ম সচিব ভাঙ্গা পার হচ্ছেন। পরে ফেরিটি লোড করা শুরু হয়, আধা ঘণ্টারও কম সময়ে ফেরিতে চলে আসে গাড়িটি। এর পর প্রায় ১১টার দিকে ফেরিটি রওনা হয়।
মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ওয়াহিদুল ইসলাম জানান, আসন্ন ঈদু ল আযহা উপলক্ষে বৃহস্পতিবার ঘাট নিয়ে প্রস্তুতি সভা ছিল। সেখানে বিআইডব্লিউটিসির ব্যবস্থাপক আব্দুস সালামও ছিলেন। সেখানেই চাঁদপুরের সাবেক জেলা প্রশাসক ও বর্তমানে যুগ্ম সচিব আব্দুস ছবুর মন্ডলের সঙ্গে তাকে ফোনে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া হয়। পদ্মায় তীব্র স্রোতের কারণে এখন ফেরি যেহেতু কম চলাচল করছে, তাই পরাপারের বিষয়ে খোঁজখবর এবং সহযোগিতার জন্যই ওই কর্মকর্তা যোগাযোগ করেন। কিন্তু রোগীকে পার না করে ফেরি অপেক্ষা করানোর বিষয়টি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাও আবার পাঁচ-দশ মিনিট নয় তিন ঘণ্টা। যদি সত্য হয়ে থাকে তবে ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এটুআই প্রকল্পের দায়িত্বরত আব্দুস ছবুর মণ্ডল এ ব্যাপারে বলেন, আমরা মানুষের লাইফ সেভ করি। আর সেখানে এমন ঘটনা ঘটবে, এটি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ফেরিতে মুমূর্ষু রোগী আছে বা আমাদের কারণে ফেরি আটকে রাখা হয়েছে এটি আমাদের জানা ছিল না। বিআইডব্লিউটিসির ব্যবস্থাপকের পরামর্শ অনুযায়ী ভাঙ্গা পার হওয়ার সময় তাকে অবহিত করা হয়েছিল মাত্র। এমনকি আমাদের গাড়িটি ফেরিতে ওঠার আরও প্রায় ১০ মিনিট পর ফেরিটি রওনা হয়।
তিতাসের মামা বিজয় ঘোষ জানান, যখন তাদের এম্বুলেন্সটি যখন এক নম্বর ঘাটে পৌঁছায়, তখন সামনে একটি মাত্র গাড়ি ছিল। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই লাইনের পেছনে ৪০/৫০টি গাড়ি জড়ো হয়। সেখান থেকে বের হয়ে অন্য ফেরিঘাটে যাওয়ারও সুযোগ ছিল না। কিন্তু যুগ্ম সচিবের গাড়িটি আসার আগেই ফেরিতে সেখান থেকে কিছু গাড়ি ওঠোনো হয় এবং বিশেষ গাড়িটির জন্য জায়গা খালি করা হয়। তিনি জানান, ফেরি চলার পরেও আশা ছিল। কিন্তু তীরে পৌঁছানোর আগেই অ্যাম্বুলেন্সেই মৃত্যু হয় তিতাসের।
বিজয় ঘোষ রোববার সন্ধ্যায় কান্না জড়িত কণ্ঠে সংবাদ মাধ্যমকে জানান, বুধবার সন্ধ্যায় এক আত্মীয়ের বরযাত্রীর বহরে মোটার সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিল তিতাস। সদ্য মোটর সাইকেল চালাতে শেখা তিতাস রাস্তায় একটি স্পিড ব্রেকারে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পায়। দ্রুত তাকে খুলনার হাসপাতালে নিয়ে রাখা হয় লাইফ সাপোর্টে। পরদিন চিকিৎসক জরুরি অপারেশনের প্রয়োজনীয়তার কথা জানান। প্রথমে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নেওয়ার চেষ্টা করা হলেও সংশ্লিষ্টদের পরামর্শে লাইফ সাপোর্ট অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছিলেন তারা।
তিতাসের কথা জানতে চাইলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিতাসের মা সোনামণি ঘোষ। তিনি বলেন, ‘বাবা তোমাগো কাছে বললে কী আমার পোলারে পামু? ওরা আমার পোলারে মেরে ফেলছে। আমি ফেরিওয়ালাগো পায়ে ধরছি, তবুও ওরা ফেরি ছাড়ে নাই। ফেরি ঠিক মতোন গেলে হয়তো পোলাডা বাঁইচা যাইতো।’