
বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ি। বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাতে ‘২৪-এর বিপ্লবী ছাত্র-জনতার’ ব্যানারে বুলডোজার কর্মসূচিতে জড়ো হওয়া বিক্ষুব্ধরা রাত ৮টার দিকে ওই বাড়িটিতে প্রথমে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন।
পরে বুলডোজার ও ক্রেন দিয়ে বাড়িটি ভাঙা শুরু হয়। রাত সোয়া ৯টার দিকে ভবনের দোতলায় অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরে রাত সাড়ে ১০টার দিকে একটি ক্রেন বাড়ির সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। রাত সাড়ে ১১টার দিকে গেট দিয়ে বাড়ি ভাঙতে ভাঙতে ক্রেনটি ভেতরে প্রবেশ করে। এ সময় উৎসুক জনতাকে ক্রেনের ওপর উঠে উল্লাস করতে দেখা গেছে। ‘শেখ মুজিবের বাড়ি ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’ বলে স্লোগান দিতে দেখা গেছে ছাত্রদের।
রাত ১১টা ৫৪ মিনিটে ভেকু মেশিনে ৩২ নম্বরের মূল বাড়ি ভাঙার কাজ শুরু হয়। এ সময় তরুণরা মুহুর্মুহু স্লোগানে এলাকা প্রকম্পিত করেন। বাড়িতে তখনো আগুন জ্বলছিল। এ সময় ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি বাজছিল লেকের পাশের একটি অস্থায়ী মঞ্চের সাউন্ড বক্সে। তরুণরা উদবাহু নেচে-গেয়ে মুহূর্ত উদযাপন করেন।
এছাড়া ‘দেশব্যাপী বুলডোজার-৩২ কর্মসূচি’র আওতায় বিভিন্ন স্থানে বঙ্গবন্ধুর ম্যুরালসহ শেখ পরিবারের স্থাপনা ভাঙচুর করা হয়। এর মধ্যে রাজধানীর ধানমন্ডির ৫ নম্বর সড়কে শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনে আগুন দেওয়া হয়। খুলনায় সাবেক সংসদ সদস্য শেখ হেলালের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে স্থাপিত বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল ভেঙে ফেলেন।
সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ছাত্র-জনতা, কুষ্টিয়ায় সাবেক সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফের বাড়ি ভাঙচুর, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও নগরের জামাল খান এলাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ভাঙচুর, রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও কারমাইকেল কলেজে স্থাপিত শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরাল ও নামফলক ভাঙচুর করা হয়।
এদিকে ৩২ নম্বরে আগুনের সংবাদ পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট ঘটনাস্থলে ছুটে যায়। তবে ছাত্র-জনতার বাধার মুখে ফায়ার সার্ভিসের ওই ইউনিটটি ফিরে যায়। রাতে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ডিউটি অফিসার রাফি আল ফারুক বলেন, ৩২ নম্বরে আগুনের সংবাদ পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়। কিন্তু বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা গাড়ি প্রবেশে বাধা দিলে গাড়ি ফিরে আসে।
রাত ১টা ৫৫ মিনিটে ঘটনাস্থলে অবস্থানকালে দেখা গেছে, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি ভাঙা বা গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজ তখনো চলছিল। ভবনের বাইরের বাউন্ডারি বা প্রাচীর ইতোমধ্যেই পুরোপুরি ভেঙে ফেলা হয়েছে।
ঘটনাস্থলে তখনো শত শত আন্দোলনকারী অবস্থান করে নানা রকম স্লোগান দিচ্ছিলেন। তার পাশে সাউন্ড সিস্টেম ব্যবহার করে চলছিল নাচগান। এদিকে আশপাশের এলাকার অনেক নারী, পুরুষ ও শিশুকে উৎসুক জনতা হিসেবে সেখানে ভিড় করতে দেখা যায়। ভবনের ভাঙা অংশ থেকে কুড়িয়ে লোহাজাতীয় সরঞ্জাম নিয়ে অনেককে বাসায় ফিরে যেতে দেখা গেছে। কেউ কেউ হাতে করে ইট নিয়ে যান।
এদিকে বুধবার রাত ৮টা থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ধানমন্ডি ৩২ নম্বরসংলগ্ন মিরপুর সড়কে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। রাত ২টায় এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এলাকায় বিপুল সংখ্যক আন্দোলনকারী অবস্থান করছিলেন। ভবনের আশপাশে আইনশৃঙ্খলার বাহিনীর কাউকে দেখা না গেলেও তো দূরে রাসেল স্কয়ারের মোড়ে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে ফুটপাতের পাশে প্লাস্টিকের মোড়া নিয়ে বসে থাকতে দেখা গেছে।
এর আগে বুধবার বিকেলে জাতীয় নাগরিক কমিটির ফেসবুক পেজ থেকে জানানো হয়েছিল, ৩২ অভিমুখে বুলডোজার মিছিল করা হবে। সেখানে বলা হয়, হাজারও ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা চালিয়ে দিল্লি পালিয়ে গিয়ে সেখান থেকেই খুনি হাসিনার বাংলাদেশবিরোধী অপতৎপরতার প্রতিবাদে ২৪-এর বিপ্লবী ছাত্র-জনতার উদ্যোগে রাত ৯টায় এ কর্মসূচি পালিত হবে।
নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা- কর্মীদের সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভার্চুয়াল অধিবেশনকে কেন্দ্র করে এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি হয় বলে জানা গেছে। গত মঙ্গলবার রাতে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে থেকে জানানো হয়েছিল, ভারতে অবস্থানরত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি বুধবার রাতে ছাত্রসমাজের উদ্দেশে বক্তব্য রাখবেন। তার বক্তব্য দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। মূলত এই উত্তেজনার সূত্র ধরে ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে ‘বুলডোজার মিছিলের’।
রাতে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, ‘ফ্যাসিবাদের দালালেরা হুঁশিয়ার সাবধান, আবু সাঈদ, মুগ্ধ শেষ হয়নি যুদ্ধ, হৈ হৈ রৈ রৈ, খুনি হাসিনা গেলি কই?, দিল্লি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’ এমন সব স্লোগান দিয়ে ৩২ নম্বর বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করেন বিক্ষুব্ধ তরুণরা। তারা মোটা লাঠি, লোহার পাইপ নিয়ে বাড়ির বিভিন্ন অংশ ভাঙচুর করেন। তারা স্লোগান দিচ্ছিলেন, ‘ফ্যাসিবাদের আস্তানা ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’। তারা হাতুড়ি, বাটাল, শাবল নিয়ে ৩২ নম্বরের বাড়ির সীমানাপ্রাচীর ভাঙতে শুরু করেন রাত সাড়ে ৮টায়। বাড়ির সামনের সড়কে তারা আগুন দেন।
রাত ৯টার দিকে ঘটনাস্থলে জিয়া পরিষদের নেতা আবদুর রহমান বলেন, ‘শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গিয়েও দেশবিরোধী নানা চক্রান্ত করছেন। ভারত সরকার তাতে নানাভাবে সহযোগিতা করছে। কোটি কোটি মানুষের দাবি, গণহত্যাকারী আওয়ামী লীগের রাজনীতি যেন নিষিদ্ধ করা হয়। আজ শেখ মুজিবের বাড়ি ভাঙার মধ্য দিয়ে কোটি কোটি মানুষের ক্ষোভ প্রকাশিত হয়েছে। কোটি মানুষের একটাই কথা, এই বাংলার মাটিতে আওয়ামী লীগ যেন পুনর্বাসিত না হয়।’
মতিঝিল থেকে আসা তরুণ নূর ই আলম বলেন, ‘আজ আমরা ফ্যাসিবাদীদের আস্তানা গুঁড়িয়ে ফেলব, সে যত রাতই হোক না কেন! আমরা এ বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়ে ফ্যাসিবাদের সব চিহ্ন মুছে ফেলতে চাই। দেশে আওয়ামী লীগের যত চিহ্ন, স্মারক আছে, সব মুছে ফেলব আমরা।’
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে বিক্ষুব্ধরা দলে দলে মিছিল নিয়ে জড়ো হন ৩২ নম্বরে। এরপর বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন তারা। রাত ৮টা নাগাদ বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের গেট ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে ভাঙচুর শুরু করেন আন্দোলনকারীরা।
বাড়িটি ভাঙার জন্য অনেকে হাতুড়ি নিয়ে আসেন। ৯টার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাস্তায় সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারা কোনো প্রস্তুতি বা সতর্কতামূলক অবস্থান নিচ্ছিলেন বলে মনে করেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। এরপর রাত ৯টা ২১ মিনিটে সেনাসদস্যরা বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন। এরপর ভাঙচুরকারী যারা ভেতর থেকে বের হচ্ছিলেন তারা ছবির ফ্রেম, বইসহ যতটুকু যা ছিল সেগুলো হাতে নিয়ে বের হচ্ছিলেন। মিনিট পাঁচেক পর ভবনের ভেতর থেকে বেশ কিছু ভাঙচুরকারী দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন। উপস্থিত অনেকে বলেছিলেন, সেনাবাহিনীর ধাওয়ায় তারা বাইরে চলে আসেন। যদিও কিছু পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও বাইরে চলে আসেন। তবে রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ বাড়ির বাইরে বাউন্ডারি দেওয়াল ভেঙে ফেলেন বিক্ষুব্ধরা।
এদিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি ভাঙার বিষয়ে আগে থেকেই ফেসবুকে নানা ঘোষণা আসতে থাকে। বুধবার রাতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ তার ভেরিফায়েড ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে মন্তব্য করেন- ‘রাতে দেশ ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমি মুক্ত হবে।’ এ ছাড়া বুধবার সন্ধ্যায় নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে ‘উৎসব হোক!’ এই দুই শব্দের স্ট্যাটাস দেন জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও অন্তর্বর্তী সরকারের যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। তবে এই স্ট্যাটাসের মাধ্যমে তিনি ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছেন সেটা পরিষ্কার করেননি।
প্রসঙ্গত, গত জুলাই-আগস্টের কোটা সংস্কারের আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। প্রবল আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হলে ওই দিনই হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা গণভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে ভাঙচুর চালান। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে আগুনও ধরিয়ে দেওয়া হয়। একই সময় জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ভবনের বাইরের অংশে রাখা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি।