
নিজস্ব প্রতিবেদক : দুই পায়ের পর এবার আলীনা ইসলাম আয়াতের মাথার অংশ উদ্ধার করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। বৃহস্পতিবার(১ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড আকমল আলী ঘাটের স্লুইসগেট এলাকা থেকে মাথাটি উদ্ধার করা হয়।
পিবিআই কর্মকর্তারা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। শিশু আয়াতের চেহারা দেখে আর্তনাদ করে ওঠেন তার বাবা। কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা, দাদাসহ স্বজনেরা। তাঁদের আহাজারিতে উপস্থিত অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। একদিন আগে বুধবার একই এলাকা থেকে আয়াতের পলিথিন মোড়ানো দুই পা উদ্ধার করা হয়েছিল।
গত ১৫ নভেম্বর নগরের ইপিজেড থানার বন্দরটিলা নয়ারহাট এলাকায় বাসার সামনে থেকে নিখোঁজ হয় আলীনা ইসলাম আয়াত। এ ঘটনায় ২৪ নভেম্বর রাতে তাদের ভাড়াটিয়া আজহারুল ইসলামের ১৯ বছর বয়সী ছেলে আবীর আলীকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই।
জিজ্ঞাসাবাদে সে আয়াতকে শ্বাসরোধে হত্যার পর ছয় টুকরো করে সাগরে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা স্বীকার করে। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরদিন লাশ টুকরোর কাজে ব্যবহৃত দা ও আয়াতের পায়ের জুতা উদ্ধার করা হয়।
পিবিআইয়ের ভাষ্যমতে, মুক্তিপণ আদায়ের জন্য আয়াতকে অপহরণের পরিকল্পনা করে আবীর। ১৫ নভেম্বর বিকেলে বাসার সামনে থেকে আয়াতকে কোলে নিয়ে আদর করতে করতে আবীর ঢুকে যায় তার বাবার বাসায়। সেখানে ১৫ মিনিটের মধ্যে শ্বাসরোধ করে সে আয়াতকে খুন করে। এর পর লাশ ব্যাগে ভরে নিয়ে যায় নগরের আকমল আলী সড়কের পকেট গেট বাজার এলাকায় তার মা আলো বেগমের বাসায়।
মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদের পর আবীর মায়ের বাসায় থাকত। বাবার বাসায়ও তার যাতায়াত ছিল। আবীর মায়ের বাসায় নিয়ে লাশ বাথরুমের সানশেডের ওপর লুকিয়ে রাখে। রাতেই ওই লাশ বাথরুমে নিয়ে কেটে ছয় টুকরো করে ছয়টি ব্যাগে ভরে রাখে।
পরদিন ১৬ নভেম্বর সকালে লাশের তিনটি টুকরো আউটার রিং রোড এলাকায় সাগরে ভাসিয়ে দেয়। ওই দিন রাতে বাকি তিন টুকরো আকমল আলী রোডের স্লুইসগেট এলাকায় ফেলে দেয়। কিন্তু মুক্তিপণ আদায়ের জন্য সংগ্রহ করা সিম ব্লক থাকায় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারেনি আবীর।
আগের দিন বুধবার আয়াতের খণ্ডিত ‘দুই পা’ উদ্ধারের পর যখন পিবিআই কর্মকর্তা ও সাংবাদিকরা তার পিতা সোহেল রানাকে সান্তনা জানাচ্ছিলেন, তখন তার আকুতি ছিল– ‘মেয়ের মাথাটা খুঁজে দেবেন? শেষবারের মতো একবার চেহারাটা দেখবো।’ সন্তানের চেহারাটি দেখার জন্য বাবার এই আকুতির জবাবে নিরুত্তর ছিলেন সবাই। তার দাবি, মেয়ে আয়াতের মাথাটিও এই স্লুইস গেটের ভেতরে আছে। তিনি বলেন, খুনি আবির তিনটি পুটলি এই স্লুইস গেটে ফেলেছে। এর মধ্যে দুইটা উদ্ধার হলে আরও একটি পুটলি থাকবে। গতকাল আয়াতের খণ্ডিত মাথাটি উদ্ধারের জন্য অনুরোধ করেন আয়াতের বাবা।
সাজতে ভালোবাসতো শিশু আয়াত:
মাদরাসায় যাওয়ার সময় হোক কিংবা বেড়াতে যাওয়ার সময় পছন্দের জামা তার চাই–ই চাই। সাথে বায়না ধরতো মায়ের কাছে, তাকে সাজিয়ে দিতে। ১৫ নভেম্বর মাদরাসায় পড়তে যাওয়ার সময় মা আলো বেগম মেয়েকে সাজিয়ে দেন। তার চুলগুলো বুঝি তার মতোই চঞ্চল; হাওয়ায় উড়তে চায় কেবল। বেনী করে দেওয়ার পাশাপাশি তাই মাথার সামনে ক্লিপ দিয়ে আটকানো ছিল এলোমেলো চুল। গতকাল তার খণ্ডিত মাথা উদ্ধারের পর দেখা গেল বিভিন্ন স্থান থেকে চুল উঠে গেলেও দুটি ক্লিপ ঠিকই আটকে আছে মাথার সামনের অংশে চুলের সাথে। মাথার চুল ও ক্লিপ দেখে দেহাংশ শনাক্ত করেন আয়াতের পিতা সোহেল রানা। হত্যার ১৭ দিনের মাথায় গতকাল বৃহস্পতিবার আকমল আলী স্লুইচ গেট এলাকার সাগরপাড় থেকে পলিথিন মোড়ানো মাথাটি উদ্ধার করে পিবিআই।
পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা বলেন, অভিযুক্ত আবিরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী আয়াতের দেহ অনুসন্ধানে আকমল আলী খালের স্লুইসগেট এলাকায় সকাল থেকে অভিযান চালায় পিবিআই। তল্লাশির একপর্যায়ে খালের স্লুইসগেট থেকে আধা কিলোমিটার দূরে সাগরের কাছাকাছি একটি পলিথিন ব্যাগে কিছু আছে বলে আমাদের জানান এক জেলে। পরে অভিযানে থাকা পিবিআই সদস্যরা আবির আলীর বর্ণনা অনুযায়ী স্কচটেপ মোড়ানো পলিথিন দেখে আয়াতের দেহাংশ থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি আরও বলেন, হত্যার ১৭ দিন হয়ে যাওয়ায় অনেকটা বিকৃত হয়ে গেছে আয়াতের চেহারা। তবে মাথার চুল ও ক্লিপ দেখে দেহাংশ শনাক্ত করেন আয়াতের বাবা। উদ্ধার হওয়া খণ্ডিত অংশগুলোর ডিএনএ টেস্ট করা হবে।
এদিকে আয়াত হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মনোজ কুমার দে বলেন, আয়াতের লাশের তিনটি খণ্ড ময়নাতদন্তের পর তার বাবার কাছে দেয়া হয়েছে।
আয়াতের পরিবারের পক্ষ থেকে জানা গেছে, গাউসিয়া কমিটি নিজস্ব অ্যাম্বুলেন্সযোগে আয়াতের দেহাংশ এলাকায় নিয়ে যায়। রাত সাড়ে নয়টার দিকে বন্দরটিলা নয়ারহাট আলী শাহ জামে মসজিদে জানাজা শেষে স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করা হয়।
সাগরপাড় পর্যন্ত আয়াতের খণ্ডিত মাথাটি কীভাবে গেল– এমন প্রশ্নের উত্তরে পিবিআই পরিদর্শক মো. ইলিয়াস খান বলেন, আমরা গতকাল স্লুইচ গেটটি খুলেছিলাম। তখন আমরা আয়াতের দুইটি পা উদ্ধার করি। হয়ত স্লুইচ গেটের নিচ দিয়ে ভাটার টানে মাথাটি সাগড় পাড়ে গিয়ে আটকায়। উদ্ধার হওয়া খণ্ডিত অংশগুলোর ডিএনএ টেস্ট করা হবে এবং বাকি অংশগুলোর সন্ধানে অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।