শনিবার, ১০ই মে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শনিবার, ১০ই মে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ শনিবার, ১০ই মে ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৭শে বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১১ই জিলকদ ১৪৪৬ হিজরি

করোনা আতঙ্ক: আমাদের যা জানা জরুরি

নূরুল ইসলাম মনি , সাবেক সাংসদ।

আজ বিশ্বের সবচেয়ে বড় আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। সারা বিশ্ব আজ থমকে দাঁড়িয়েছে। উন্নত-অনুন্নত প্রায় সব দেশই আজ করোনা আক্রান্ত। তাই আমাদের জরুরি ভিত্তিতে যা জানা ও পালন করা দরকার-

করোনাভাইরাস কী?

করোনা একটি অণুজীব যা খালি চোখে দেখা যায় না। এটি যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এ পর্যন্ত সে ৩৮০ বার নিজেকে পরিবর্তন করে মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। সমগ্র বিশ্বের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। যে কারণে বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত তাকে ধ্বংস করার মতো কার্যকর কোনো ওষুধ আবিষ্কার করতে পারেননি। এটি বাতাসে ভাসে- তবে বেশি নয়। যে কোনো জিনিসের ওপর পড়ে সে ৭-৮ ঘণ্টা থেকে ৪-৫ দিন পর্যন্ত বাঁচতে পারে। কেবল ৭০ ডিগ্রি বা তার উপরের তাপমাত্রায় সে মারা যায়।

আক্রান্ত ব্যক্তির লক্ষণ কী এবং রোগ হলে ক্ষতি কী?

প্রধান লক্ষণ : শুরুতে সর্দি, কাশি, গলাব্যথা, শরীর ব্যথা, জ্বর, বমিভাব। আক্রান্তের ৩-৫ দিনের মধ্যে এ লক্ষণ দেখা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লক্ষণ সামান্য হতে পারে। ৭-৮ দিন পর মৃদু শ্বাসকষ্ট, পেটে ব্যথা বা পাতলা পায়খানা এবং জ্বর দেখা দেয়। এরপর ফুসফুস আক্রান্ত হয়ে তীব্র শ্বাসকষ্টসহ শরীরের বিভিন্ন অর্গান নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকলে রোগী মারা যেতে পারে।

আক্রান্ত হওয়ার বেশি ঝুঁকিতে কারা?

কেউ ঝুঁকিমুক্ত নয়, তবে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং যারা ইতোমধ্যে বিভিন্ন রোগ যেমন: অ্যাজমা, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস, ক্যানসার, টিবিসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত। ধূমপায়ীদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও অনেক বেশি।

করোনা ভাইরাস কীভাবে ছড়ায় ?

এটি খুবই ছোঁয়াচে জীবাণু। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, সর্দি এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মূলত ছড়ায়। আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে অর্থাৎ ৩-৫ ফুটের মধ্যে কোনো সুস্থ মানুষ এলেই তার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রবল। আক্রান্ত ব্যক্তি কোনো কিছু ধরলে এবং তা পরে সুস্থ মানুষ ধরলেই ওই ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারেন। যেমন: দরজার হাতল বা নব, তালা, লিফটের বোতাম, সিঁড়ির হাতল, এটিএম বুথের বাটন, পানির কল, কমোডের ফ্ল্যাশ, কমোডের সিটার, কাগজ (লঞ্চ, বাস, বিমানের টিকিট, অফিসের খাতাপত্র, স্কুল-কলেজের বইপত্র, খবরের কাগজ ইত্যাদি), কলম, পেনসিল, ব্যাগ, থলে, বাক্স, কাগজের টাকা বা মুদ্রা ইত্যাদি। আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত বস্তু যেমন: টেবিল-চেয়ার, খাট, বিছানা, আসবাবপত্র, প্লেট, গ্লাস, টেলিফোন, ক্যামেরা, চশমা, টাওয়াল ইত্যাদি সুস্থ মানুষ ব্যবহার করলে। এ ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তি যানবাহনের যে সিটে বসবেন বা যে হাতল ধরবেন সেখানে বসলে বা ধরলে।

কীভাবে জীবাণুটি শরীরে প্রবেশ করে?

মূলত নাক, মুখ, চোখ ও কানের মাধ্যমে জীবাণুটি শরীরে প্রবেশ করে। সে জন্য আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি, কাশি, সর্দি, কফ, থুতু থেকে সাধ্যমতো দূরে থাকতে হবে। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, হাত অর্থাৎ নিজের হাত না ধুয়ে কোনোভাবেই মুখমণ্ডলে লাগানো যাবে না। আমরা যা কিছু ধরি, আর তার মধ্যে যদি করোনার জীবাণু থাকে এবং সেই হাত যদি জীবাণুসহ মুখমণ্ডলে স্পর্শ করি তাহলে আর রক্ষা নেই।

এই রোগে চিকিৎসা কী?

মূলত এ রোগের এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকর ওষুধ আবিষ্কার হয়নি, আর আতঙ্ক এ কারণেই। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা ওষুধ আবিষ্কারের জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ওষুধ না থাকার কারণে বয়স্ক মানুষ এবং জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীদের সমস্যা সবচেয়ে বেশি এবং তাদের মৃত্যুর হারও বেশি। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে রোগী নিজে নিজে সুস্থ হতে পারেন। স্বল্প বয়সের রোগীদের এ কারণে মৃত্যুর হার কম। এ রোগ থেকে বাঁচার সবচেয়ে বড় উপায় হল- রোগটি না হতে দেয়া; সামান্য চেষ্টা করলেই তা আমরা করতে পারি।

কীভাবে আমরা রোগটি হতে দেব না?

আমরা কোনোভাবেই আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি যাব না। আক্রান্ত ব্যক্তি কে- তাকে আমরা চিনি না বা জানি না, সে কারণে আমরা যে কোনো লোক সমাগম এড়িয়ে চলব। সাময়িকভাবে আমরা সব ধর্মীয় অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মিলাদ মাহফিল, ওয়াজ মাহফিল, বিবাহ অনুষ্ঠান, সামাজিক সব অনুষ্ঠান পরিহার করব। এমনকি বাজারে যাওয়া ও চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়া থেকে বিরত থাকব।

আমরা বাসে, লঞ্চে, ট্রেনে, প্লেনে চলাচল বন্ধ রাখব। আমরা কি ভেবে দেখেছি যে রিকশা বা মোটরসাইকেলের পেছনে আমি বসেছি, সেই রিকশাওয়ালা বা মোটরসাইকেলওয়ালাও করোনায় আক্রান্ত কি না? মনে রাখতে হবে।

একজন করোনার রোগী বাজার, কোনো অনুষ্ঠান বা কোনো জনসমাগম আছে এমন কোথাও গেলে একাই একদিনে শত শত মানুষকে আক্রান্ত করতে পারেন। ওই শত শত মানুষের মাধ্যমে হাজার হাজার, লাখ লাখ মানুষ আক্রান্ত হতে পারে। ইতালি তার জ্বলন্ত প্রমাণ। তাই আক্রান্ত রোগীকে আমরা কোনোভাবেই কোথাও বের হতে দেব না এবং আমরাও রোগীর কাছাকাছি আসব না।

বিদেশ থেকে আগত সব মানুষকে, এমনকি আক্রান্ত না হলেও কমপক্ষে ১৫ দিন নির্জনে একা একা থাকার ব্যবস্থা করতে হবে (কারণ, এ রোগটি আক্রান্ত হওয়ার ১৪ দিনের মধ্যেই প্রকাশ পায়)। আমরা নিজেরাও যে যার ঘরে অবস্থান করব এবং আশপাশের সবাইকে ও আত্মীয়স্বজনকে বলব ঘরে থাকার জন্য। যেভাবে চীন করোনা মোকাবেলা করেছে। বিশ্বের সব ধনী দেশ সবকিছু বন্ধ করে দিয়েছে।

বহু দেশে কারফিউ পর্যন্ত জারি করা হয়েছে যাতে মানুষ ঘর থেকে বের হতে না পারে। জরুরি প্রয়োজনে বাইরে গেলে সুযোগমতো বারবার সাবান দিয়ে কমপক্ষে ২০ সেকেন্ড পর্যন্ত হাত ধোব- হাতের কব্জির ওপর পর্যন্ত। হাত ধুতে না পারলে অ্যালকোহলযুক্ত স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করব। হাত ধোয়ার পর পানি দিয়ে মুখ ও নাক পরিষ্কারসহ সম্পূর্ণ মুখমণ্ডল ধৌত করব।

কোনোভাবেই হ্যান্ডশেক, কোলাকুলি করব না। সুযোগমতো লবণযুক্ত গরম পানি দিয়ে গলা পরিষ্কার (গার্গল) করব। বাইরে থেকে এলে কোথাও না বসে কাপড়চোপড় ধুয়ে ফেলব বা একটা ঢাকনাওয়ালা বালতিতে ঢেকে রাখব এবং সময়মতো ধুয়ে নেব। কোনো কাপড় ধোয়া সম্ভব না হলে উজ্জ্বল রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে নেব। সম্ভব হলে ঘরে এসে হালকা গরম পানি দিয়ে গোসল করে নেব অথবা হাত-মুখ পরিষ্কার করব।

ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ খাবার খাব, সবুজ শাকসবজি, সুষম খাবার, মাছ, মাংস, ডিম ভালো করে সিদ্ধ করে খাব (ডিমের পোচ খাওয়া যাবে না) যাতে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনোভাবেই ঠাণ্ডা কোনো খাবার খাওয়া যাবে না। কিছু সময় পরপর গরম কফি, চা, গরম পানি বা স্যুপ খেলে ভালো হয়। ঘরে বসে ব্যায়াম করব, পরিবারকে সময় দেব, যার যার ধর্ম অনুযায়ী স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করব।

কোয়ারেন্টিন বা আইসোলেশন নিয়ে বিভ্রান্তি :

আমাদের দেশে স্বয়ং শিক্ষিত এবং গ্রামের মানুষেরা কোয়ারেন্টিন শব্দ নিয়ে চরম বিভ্রান্তিতে পড়েছেন। যেহেতু শব্দটি তাদের পরিচিত নয় সেহেতু কোয়ারেন্টিন কী তা বুঝতে কোয়ারেন্টিনে থাকা রোগী দেখার জন্য দলে দলে ভিড় করেছেন রোগীর বাড়িতে। জরুরি ভিত্তিতে তাদের বোঝাতে হবে কোয়ারেন্টিন আসলে কিছুই না, শুধু আলাদা থাকা।

বাংলাদেশে করোনার ভয়াবহতা কী হতে পারে?

এক কথায় চরম ভয়াবহ হতে পারে যদি আমরা সচেতন না হই। আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য নয়; নিজেদের বাঁচার জন্য বলছি, সচেতনতার জন্য বলছি- করোনা আমাদের দেশীয় কোনো রোগ নয়। এটি আমাদের আত্মীয়স্বজনই বিদেশ থেকে নিয়ে এসেছেন। এখানে প্রতিদিন গড়ে ৭ থেকে ৮ হাজার মানুষ বিদেশ থেকে আসছেন এবং গ্রামেগঞ্জে চলে যাচ্ছেন। অসচেতনতার কারণে এবং তারা কোয়ারেন্টিনের ভয়ে ডাবল ডোজের প্যারাসিটামল খাচ্ছেন প্লেনে বসেই যাতে জ্বর ধরা না পড়ে। সঙ্গত কারণেই তারা অনেকেই করোনা নিয়ে বাড়িতে যাচ্ছেন।

ওইসব মানুষ গ্রামেগঞ্জে যার সংস্পর্শে আসবেন তারই করোনা হতে পারে। আর তাই যদি হয় তাহলে যে কোনোদিন আমরা দেখব করোনা আমাদের গ্রাস করেছে। তখন সরকার হাজার চাইলেও কিছু করতে পারবে না। কারণ, আমাদের হাসপাতাল সীমিত, ডাক্তার-নার্স সীমিত, সুযোগ-সুবিধা সীমিত। তার ওপর বিশালসংখ্যক রোগী সামাল দেয়ার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি নেই।

সুতরাং এখনও সময় আছে আমাদের জেগে ওঠার। যে যেখানে আছি সে সেখান থেকেই সচেতন হই এবং যতদূর সম্ভব আশপাশের সবাইকে সচেতন করি। ইতালি, চীন, ইরান কি আমাদের চোখ খুলে দেয়নি?

সেই সঙ্গে সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে এর গুরুত্ব অনুধাবন করে চালকের ভূমিকায় বসার জন্য বিনীত অনুরোধ করছি। এখনই সময় শক্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Telegram
WhatsApp
Email
Print