
প্রভাতী ডেস্ক : দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ থেকে পরিবারের সবাইকে হত্যার পরিকল্পনা করেন বলে দাবী করেছেন মেহজাবিন।
রাজধানীর কদমতলীতে মা, বাবা ও বোনকে হত্যার দায় একাই স্বীকার করে মেহজাবিন ইসলাম মুন হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিচ্ছেন। তার মা তাকে দিয়ে দেহব্যবসা করিয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন। তার দাবি বোনকে দিয়েও মা দেহব্যবসা করাচ্ছিলেন। তিনি জানান, তার বাবা বিদেশে থাকায় মা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। মা পরকীয়ায়ও লিপ্ত ছিলেন।
পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) শাহ ইফতেখার আহমেদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এদিকে মেহজাবিনের বিরুদ্ধে মামলা করা হলে আদালত তার ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মেহজাবিন আরো জানান, তিনি (মেহজাবিন) মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। পঞ্চম শ্রেণি ও অষ্টম শ্রেণিতে টেলেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিলেন। অথচ তার মা তাকে দিয়ে দেহব্যবসা করিয়েছেন। বোনকে দিয়েও মা দেহব্যবসা করাচ্ছিলেন। ছোট বোনকে রক্ষা করতে তিনি নিজের বাসায় রেখেছিলেন। কিন্তু সেখানেও তাকে দেহব্যবসায় নিয়োজিত করা হয়। সম্প্রতি বাবা দেশে ফিরলে তার কাছে তিনি নালিশ দেন। কিন্তু মায়ের কোনো বিচার করেননি বাবা। এতে প্রচণ্ড হতাশাবোধ থেকে তিনি একক পরিকল্পনায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন।
পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, স্বামী দেশে না থাকায় মৌসুমী তার দুই মেয়েকে দিয়ে দেহব্যবসা করাতেন। এসব নিয়ে প্রতিবাদও করেছিলেন মেহজাবিন। কিন্তু কোনো ফল হয়নি। তার বিয়ে হলে ছোট মেয়ে মোহিনীকে দিয়ে তিনি দেহব্যবসা চালাচ্ছিলেন। এর মধ্যে শফিক ও মোহিনীর মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এছাড়া মেহজাবিনের বাবা মাসুদ রানা সৌদি আরবে আরেকটি বিয়ে করেছেন। এসব মিলিয়ে দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ থেকে পরিবারের সবাইকে হত্যার পরিকল্পনা করেন মেহজাবিন।
এদিকে রোববার (২০ জুন) ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দেবব্রত বিশ্বাস শুনানি শেষে মেহজাবিনের ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর আগে কদমতলী থানা পুলিশ তাকে ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়ার জন্য আদালতে আবেদন করে। শনিবার রাতে মেহজাবিনের বাবা মাসুদ রানার বড় ভাই সাখাওয়াত হোসেন বাদী হয়ে কদমতলী থানায় মামলা করেন। মামলায় তিনি ভাতিজি মেহজাবিন ও তার স্বামী শফিকুল ইসলামকে আসামি করেছেন। তবে মামলায় পরকীয়া এবং দেহব্যবসার বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ২৬ বছর ধরে সৌদি আরবে ছিলেন মাসুদ রানা। তিনি মাঝে মধ্যে দেশে আসতেন। তার বড় মেয়ে মেহজাবিনের সঙ্গে শফিকুলের বিয়ে হয়। কিন্তু বিয়ের পর থেকে তারা মৌসুমী ইসলামকে (মেহজাবিনের মা) বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে জ্বালা-যন্ত্রণা দিয়ে আসছেন। সব সময় তারা টাকা-পয়সা দাবি করতেন। তাদের নামে সম্পত্তি লিখে দেওয়ার জন্যও তারা চাপ দিতেন। রাজি না হওয়ায় আসামিরা মাসুদ রানা, মৌসুমী ইসলাম ও জান্নাতুল ইসলাম মোহিনীকে ছয় মাস ধরে হত্যার পরিকল্পনা করে আসছিলেন। তিন মাস আগে মাসুদ রানা দেশে ফিরে কদমতলীর মুরাদপুর এলাকায় স্ত্রী ও ছোট মেয়েকে নিয়ে বসবাস করছিলেন। এজাহারে আরো বলা হয়, শুক্রবার বিকাল ৫টার দিকে আসামিরা শ্বশুরের বাসায় আসেন। রাতে চা, কপি ও পানির সঙ্গে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তিনজনকে অচেতন করেন। এরপর তাদের হাত-পা বেঁধে ও গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়।
মামলার বাদী সাখাওয়াত হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, মামলার দুই নম্বর আসামি শফিক একজন খুনি ও একাধিক মামলার আসামি। পাঁচ বছর আগে কেরানীগঞ্জে তিনি ১জনকে হত্যা করেন। সে মামলা থেকে রেহাই পেতে শ্বশুরের কাছ থেকে টাকা নিতে প্রায় স্ত্রী মেহজাবিনকে চাপ দিতেন। টাকার জন্য স্ত্রীর সঙ্গে তার প্রায় ঝগড়া হতো। এছাড়া শফিক তার শ্যালিকা মোহিনীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। এ ঘটনা জানতে পেরে শাশুড়ি মৌসুমী তাকে বাধা দেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া হতো। শফিকের সঙ্গে মৌসুমী পেরে উঠতে না পেরে মোহিনীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠান। তবে শফিক তদবির করে তাকে কারাগার থেকে বের করে আনেন এবং আবারো তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক শুরু করেন। এ নিয়ে স্ত্রী মেহজাবিন এবং শাশুড়ি মৌসুমীর সঙ্গে শফিকের কলহ লেগেই থাকত। চার বছর আগে শাশুড়িকে হত্যার উদ্দেশ্যে শফিক তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন। তার চিকিৎসা করাতেও বাধা দেওয়া হয়। দরজা-জানালা বন্ধ করে প্রায়ই শাশুড়ি মৌসুমীকে শফিক মারধর করতেন।
উপকমিশনার শাহ ইফতেখার আহমেদ জানান, মামলায় যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে সেসবের সত্যতা পাওয়া যায়নি। তবে সবকিছুই তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। কদমতলী থানার ওসি জামাল উদ্দিন মীর বলেন, মেহজাবিনের স্বামীকেও আমরা সন্দেহের বাইরে রাখছি না। তাকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সম্পত্তির বিষয়ও এখানে রয়েছে। তদন্তে এসব আসবে।
মেহজাবিনের খালা ইয়াসমিন জানান, পাঁচ বছর আগে পারিবারিকভাবে শফিক ও মেহজাবিনের বিয়ে হয়। এর কিছুদিন পর মেহজাবিনের আগের সম্পর্ক নিয়ে তাদের দাম্পত্য কলহের সৃষ্টি হয়। বিয়ের ছয় মাসের মাথায় মেহজাবিনের সাবেক কথিত প্রেমিক আমিনকে হত্যা করেন শফিক। এর আগে শাশুড়ি মৌসুমী ও খালা-শাশুড়ি শিউলিকে দিয়ে আমিনকে তিনি ডেকে নেন। এ কারণে আমিন হত্যা মামলায় ওই দুজন ও মেহজাবিনকে আসামি করা হয়। এ মামলায় ছয় মাস কারাগারে থাকার পর জামিন পান শফিক। এরপর মোহিনীর ওপর নজর পড়ে তার। নানাভাবে তাকে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন শফিক। বিষয়টি নিয়ে একপর্যায়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করেন মৌসুমী। আবার তার বিরুদ্ধেও পালটা মামলা করেন শফিক।
এদিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শফিকের দাবি, তার স্ত্রী মেহজাবিন অনেকদিন ধরে উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপন করে আসছিলেন। এ নিয়ে তাদের মধ্যে কলহ হতো। মা-বাবার সঙ্গেও তার সম্পর্ক ভালো ছিল না।
বিভিন্ন সূত্রের দাবি, মাসুদ রানা প্রায় ২৬ বছর মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন। এ কারণে মৌসুমী অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। কয়েকজন যৌনকর্মীকে দিয়ে তিনি দীর্ঘদিন অসামাজিক কার্যকলাপ চালিয়েছেন। এমনকি নিজের দুই মেয়েকে দিয়েও তিনি দেহব্যবসা করিয়েছেন। এক সময় তার কথিত প্রেমিকের সঙ্গে মেয়ে মেহজাবিনের বিশেষ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের অন্তরঙ্গ ভিডিও কেউ ধারণ করেন। এরপর এক রকম জোর করেই শফিকের সঙ্গে মেহজাবিনের বিয়ে দেন মৌসুমী।
উল্লেখ্য, শনিবার সকালে কদমতলীর মুরাদপুর রজ্জব আলী সরদার রোডের পাঁচতলা বাড়ির দ্বিতীয়তলা থেকে মাসুদ রানা (৫০), তার স্ত্রী মৌসুমী ইসলাম (৪০) ও মেয়ে জান্নাতুল ইসলাম মোহিনীর (২০) লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। অচেতন অবস্থায় মেহজামিনের স্বামী শফিকুল ইসলাম ও মেয়ে তৃপ্তিকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়।
মেহজাবিন বলেছেন, ‘পরিবারের সাথে আমার দ্বন্দ্ব ছিল। এছাড়া ছোট বোনের সাথে আমার স্বামীর পরকীয়া ছিল। এ কারণে আমি তাদের হত্যা করি। এ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান হয়েছে বলে আমি মনে করছি।’ রোববার (২০ জুন) আদালত প্রাঙ্গণে এভাবেই কথাগুলো জাগো নিউজকে বলছিলেন তিনি। হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে মেহজাবিন আরো বলেন, ‘এ তিনজনকে আমি একাই হত্যা করেছি। এ হত্যাকাণ্ডের সাথে কেউ জড়িত নয়। আমি এতে বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নই।’
পুলিশ জানিয়েছে, মেহজাবিন তার বাবা-মা ও বোনকে হত্যা করে ৯৯৯-এ কল করে। এ সময় তিনি বলেন, ‘আপনার দ্রুত না আসলে আমার স্বামী ও মেয়েকে খুন করে ফেলব।’ পরে দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে পুলিশ নিহত তিনজনের লাশ উদ্ধার করে। অন্য দুজনকে অচেতন অবস্থায় ঢামেকে পাঠায়।