মঙ্গলবার, ১৫ই জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

মঙ্গলবার, ১৫ই জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ মঙ্গলবার, ১৫ই জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩১শে আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৯শে মহর্‌রম ১৪৪৭ হিজরি

রোহিঙ্গা ফেরত ইস্যুতে সৌদি সরকারের চাপে সংকটে বাংলাদেশ !

প্রভাতী ডেস্ক: চার দশক আগে আশ্রয় দেওয়া প্রায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠাতে নতুন করে কঠোর চাপ প্রয়োগ করছে সৌদি আরব। এমনকি এই রোহিঙ্গাদের ফেরত না নিলে বাংলাদেশ থেকে আর কোনো কর্মী ও শ্রমিক নেবে না এবং কর্মরত শ্রমিকদের ফেরত পাঠানোরও হুমকি দিয়েছে দেশটি। ফলে নতুন করে সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্নিষ্ট সূত্র জানায়, বিষয়টি সমাধানের জন্য পররাষ্ট্র সচিব ও স্বরাষ্ট্র সচিবের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়টি সমাধানের জন্য নিয়মিত জোরালো তৎপরতাও চলছে।

সূত্র জানায়, ১৯৭৭ সালে তৎকালীন সৌদি বাদশাহ খালিদ বিন আব্দুল আজিজ আল সৌদ উদার মানবিক দৃষ্টির পরিচয় হিসেবে ৫৪ হাজার রোহিঙ্গাকে সৌদি আরবে আশ্রয় দেন এবং পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তারা সৌদি আরবে অবস্থান করবেন বলে ঘোষণা দেন। এর পর থেকে এই রোহিঙ্গারা সৌদি আরবেই বসবাস করে আসছেন। দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে এই রোহিঙ্গাদের সংখ্যা সন্তান-সন্ততি, নাতি-পুতি মিলিয়ে বর্তমানে আড়াই লাখ। এখন এদের ফেরত পাঠাতে চায় সৌদি। বেশ আগে থেকেই সৌদি আরব এই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য বলে আসছিল। সম্প্রতি এ চাপের মাত্রা ব্যাপক বাড়িয়েছে বলে সংশ্নিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠাতে গত ৬ মাসে তিনটি নোট ভারবাল পাঠিয়েছে সৌদি কর্তৃপক্ষ। এসব নোট ভারবালে সৌদি কর্তৃপক্ষ দাবি করে, এই রোহিঙ্গারা ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ থেকে সৌদি আরবে এসেছে। এতদিন তাদের আশ্রয় দিলেও এখন তাদের আর রাখতে চায় না সৌদি। যেহেতু তারা বাংলাদেশ থেকে এসেছে এ কারণে তাদের জন্য বাংলাদেশি পাসপোর্ট ইস্যু করে তাদের বাংলাদেশে নিয়ে যেতে হবে; কিন্তু তারা যে বাংলাদেশ থেকে গেছে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ সৌদি কখনোই হাজির করতে পারেনি।

সর্বশেষ গত সপ্তাহে পাঠানো নোট ভারবালে সৌদি কর্তৃপক্ষ অনেকটা হুমকির ভাষায় জানায়, এই রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেওয়া হলে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক নেওয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেওয়া হবে। ফেরত পাঠানো হবে বর্তমানে সৌদি আরবে কর্মরত প্রায় ২২ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক। এ ছাড়া মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা সংকট ইস্যুতে সব ধরনের সহায়তা বন্ধ করে দেওয়া হবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ ধরনের হুমকি নজিরবিহীন। কারণ এই রোহিঙ্গারা কখনোই বাংলাদেশে ছিল না। তারা কীভাবে সৌদি আরবে গেছে, তাদের নামে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছিল কিনা, সে ব্যাপারে কোনো তথ্যই নেই। এ কারণে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সৌদি কর্তৃপক্ষকে বলা হয়েছে, যদি আগে কারও নামে বাংলাদেশি পাসপোর্ট ইস্যু করার কোনো তথ্য থাকে, তাহলে তা বাংলাদেশকে সুনির্দিষ্টভাবে জানানো হোক। তাহলে তাদের বাংলাদেশে নিয়ে আসার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এজন্য পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র সচিব সমন্বয়ে একটি যাচাই-বাছাই কমিটিও করা হয়েছে। সৌদি কর্তৃপক্ষ কারও ব্যাপারে বাংলাদেশি পুরোনো পাসপোর্ট বা বাংলাদেশে আগে অবস্থানের কোনো তথ্য দিলে সেটি এই কমিটি যাচাই-বাছাই করে সুপারিশ করবে। এর ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। কিন্তু সৌদি কর্তৃপক্ষ এই কমিটির প্রস্তাবের কোনো গুরুত্ব না দিয়ে তাদের দেওয়া একটি তালিকা অনুযায়ী গণহারে পাসপোর্ট ইস্যু করার দাবি তুলে অন্যায় চাপ দিচ্ছে বলে সূত্র জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, ১৯৭৭ সালে তৎকালীন সৌদি বাদশাহ নিজে এই রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেন। এরপর তারা সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। তাদের কাজের সুযোগও দেয় সৌদি কর্তৃপক্ষ। তাদের সন্তান-সন্ততি সৌদি আরবে জন্ম নিয়েছে, তারা আরবি ভাষায় কথা বলে। বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্কই এখন আর নেই। এখন হঠাৎ করে তাদের বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য সৌদি কর্তৃপক্ষের চাপ প্রয়োগ কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সৌদি কর্তৃপক্ষের আরও বক্তব্য হচ্ছে, যেহেতু বাংলাদেশে এরই মধ্যে দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গা আছে, অতএব রোহিঙ্গাদের আশ্রয়স্থল বিবেচনায় এদের বাংলাদেশেই পাঠানো হবে।

কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ২০১৭ সালে রাখাইনে মিয়ানমার বাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতনে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মানবিক বিবেচনায় জরুরি আশ্রয় দিয়েছে এবং তাদের কোনোভাবেই বাংলাদেশে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ নেই। তাদের নিজের দেশ মিয়ানমারে ফেরত যেতেই হবে এবং তাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বহুমাত্রিক কূটনৈতিক তৎপরতা চলছে। বাংলাদেশ চায় রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায় ও নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমে বহু বছর ধরে চলা এ সংকটের স্থায়ী সমাধান। এই অবস্থায় বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে মনে করছে সৌদি। এটা খুবই দুঃখজনক এবং দুর্ভাগ্যজনক হিসেবে মনে করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র।

সূত্র আরো জানায়, এ ধরনের চাপ খুবই বিব্রতকর। বাংলাদেশ সৌদি আরবকে যুক্তিসংগত ব্যাখ্যা দিয়ে বিষয়টি বোঝানোর চেষ্টা করছে। যেন তারা বাংলাদেশের ওপর এ রকম অনৈতিক চাপ প্রয়োগ না করে।
অন্য একটি সূত্র জানায়, এর আগেও একাধিকবার জয়েন্ট কমিটির বৈঠকে সৌদি আরবের পক্ষ থেকে এই রোহিঙ্গাদের প্রসঙ্গ তোলা হয়। সে সময়ও তারা এদের বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে চাপ দেয়। গত ফেব্রুয়ারি মাসেও এ ধরনের একটি বৈঠকে সৌদি আরব রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ইস্যু তোলে। এ সময় এই রোহিঙ্গাদের অনেকের কাছে বাংলাদেশি পাসপোর্ট আছে বলেও দাবি করা হয়। তবে তাদের কাছে পাসপোর্ট থাকার কোনো তথ্য-প্রমাণ এখন পর্যন্ত সৌদি কর্তৃপক্ষ দিতে পারেনি। এমনকি তারা বাংলাদেশ থেকে গেছে কিংবা তারা বাংলাদেশের কোন অঞ্চলে ছিল, সে সম্পর্কেও কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তবে এই প্রথমবারের মতো সৌদি কর্তৃপক্ষ এই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট হুমকি দিয়েছে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, রোহিঙ্গা সংকট ইস্যুতে সৌদি আরবের সক্রিয় ভূমিকা কখনোই দেখা যায়নি। রোহিঙ্গারা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্ব দেওয়া হিসেবে সৌদি আরবের যে ভূমিকা প্রত্যাশিত ছিল, তা দেখা যায়নি। মুসলিম উম্মাহর দেশ হিসেবে সৌদি আরবের উচিত ছিল ২০১৭ সালের পর আরো বেশি রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে সত্যিকার অর্থে মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের পরিচয় দেওয়া। সৌদি আরব বিশ্বের ধনীতম দেশগুলোর একটি। বাংলাদেশ যেখানে উদারতা ও মানবিকতার পরিচয় দিয়ে অসহায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে, সেখানে সৌদি আরবের এ ধরনের কোনো ভূমিকাই দেখা যায়নি। এমনকি রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় সৌদি আরবের অর্থনৈতিক সহায়তার পরিমাণও খুব কম। এ অবস্থায় এখন সৌদি আরব ৪ যুগ আগে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে পাঠানোর যে দাবি তুলেছে, তা একই সঙ্গে হাস্যকর ও অবিবেচনাপ্রসূত। কারণ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ-সৌদি আরব দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অত্যন্ত চমৎকার। বন্ধু-রাষ্ট্র হিসেবে সৌদি দেখছে রোহিঙ্গাদের বিশাল বোঝা কীভাবে বাংলাদেশকে সংকটে ফেলেছে। এ অবস্থায় আড়াই লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য চাপ, হুমকি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

তিনি আরো বলেন, সৌদি আরবের কূটনৈতিক অবস্থান ও আচরণ নিয়ে নানা বিতর্ক আছে বিশ্বজুড়েই। তারা একবার কঠোর আচরণ করে, পরে যখন বুঝতে পারে তখন নরম হয়। অতীতে এ ধরনের একাধিক উদাহরণ আছে। অতএব সৌদি আরব এখন চাপ দিচ্ছে। কিন্তু বিষয়টি বুঝাতে সক্ষম হলে সৌদি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করতে পারে। আশা করা যায়, বাংলাদেশ কূটনৈতিক দক্ষতা দিয়ে সৌদি আরবকে বোঝাতে সক্ষম হবে। সৌদি আরবের সঙ্গেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক অটুট থাকবে।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Telegram
WhatsApp
Email
Print