প্রভাতী ডেস্ক: বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সূচক নিয়ে কতিপয় অর্থনীতিবিদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছে জার্মান সংবাদ ডয়ছে গেলে। এই সাক্ষাৎকারে অর্থনীতিবিদগণের প্রদানকৃত বক্তব্যমতে ২০১৯ সালের অর্থনীতির সব সূচক বিগত ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে নিন্মগামী।
প্রবাসী আয় ছাড়া বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রায় সব সূচকের নিম্নমুখী প্রবণতাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন অর্থনীতিবিদরা৷ তাদের আশঙ্কা, এখনই সতর্ক না হলে মন্দার কবলে পড়তে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি৷ বাংলাদেশে এখন রপ্তানি এবং আমদানি বাণিজ্যের সূচক নিম্নমুখী৷ বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে৷ লেনদেনের ভারসাম্যও কমছে৷ কমছে বেসরকারি ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি৷ ব্যাংক খাত থেকে সরকারের ঋণ নেয়া বাড়ছে৷ বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই)-এর নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালেচনা করে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ ভাগ নয়, ৬ ভাগ হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে৷ অর্থনীতি পড়তে পারে মন্দার কবলে৷ এটা বৈশ্বিক মন্দা পরিস্থিতির জন্য নয়, আমাদের কারণেই হচ্ছে৷ বাইরের মন্দার প্রভাব শুধুমাত্র আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যে পড়ছে৷’’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেবে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কমছে৷ অক্টোবরে ৩০৭ কোটি ৩২ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে বাংলাদেশ, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৭ দশমিক ১৯ শতাংশ কম৷ আগস্ট মাসে গত বছরের আগস্টের চেয়ে সাড়ে ১১ শতাংশ আয় কম আর সেপ্টেম্বরে ৭ দশমিক ৩০ শতাংশ কম হয়েছে৷ চলতি অর্থবছরের চার মাসের (জুলাই থেকে অক্টোবর) গড় হিসেবে রপ্তানি আয় কমেছে ৭ শতাংশ৷
গত জুলাই মাসে বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৯৭ কোটি ৯০ লাখ ডলার৷ আগস্ট শেষে এটি বেড়ে দাঁড়ায় ১৯৯ কোটি ডলার৷ আর সেপ্টেম্বর শেষে এটি দাঁড়িয়েছে ৩৭১ কোটি ৭০ লাখ ডলারে৷
সেপ্টেম্বর মাস শেষে বার্ষিক ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে৷ বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদের মধ্যে এটিই সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি৷ গত প্রায় এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহতভাবে কমছে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ৷ চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে গত বছরের একই সময়ের চেয়ে রাজস্ব আদায় বেড়েছে মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৭ শতাশ কম৷ গত অর্থবছরের মতো চলতি অর্থবছরেও রাজস্ব আহরণে বড় ঘাটতির দিকে যাচ্ছে বাংলাদেশ৷
আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘‘ব্যাংকের ঋণ বিতরণ কমে যাওয়া মানে হলো বিনিয়োগ কমছে৷ কমছে উৎপদন৷ ফলে আমাদেরর রপ্তানিও কমছে৷ ব্যাংকখাতের অবস্থা খুবই খারাপ৷ খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপের দিকে যাচ্ছে৷’’ তার মতে, আমদানি, বিশেষ করে কাঁচামাল আমদানি কমা খারাপ অর্থনীতির লক্ষণ৷
এ পরিস্থিতিতে তার আশঙ্কা, ‘‘পোশাক রপ্তানিতে আমরা আমাদের অবস্থান আর ধরে রাখতে পারব বলে মনে হয় না৷” তার মতে, পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য অনেক কিছুই করা হয়নি, ‘‘অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য আমরা কি করেছি? সুশাসনের জন্য আমরা কি করেছি? দুর্নীতি বন্ধ হয়নি৷ দেশের টাকা বাইরে পাচার হয়ে যাচ্ছে৷’’
বিআইডিএস-এর অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘যদি আমাদের শিল্প উৎপাদন বাড়তো, তাহলে তো ভ্যাট বাড়তো৷ আমাদের রাজস্ব আয় হতাশাব্যঞ্জক৷ আয়কর খাত থেকেও রাজস্ব বাড়ছে না৷ সরকার ঋণ করছে৷ সেই টাকায় যদি শুধু বেতন দেয়া হয় তাহলে তো পরিস্থিতি খারাপ৷ বড় বড় ঋণ খেলপি ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে৷ আটকে যাচ্ছে মাঝারি এবং ছোট আকারের খেলাপিরা৷ আমার কথা হলো তাদের সুযোগ দিয়ে তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো সচল রাখুন, বড়দের ধরুন৷ তারা আসলে লুপপাটের সাথে জড়িত৷’’
তবে বাংলাদেশ এখনো রেমিটেন্সে ইতিবাচক ধরা ধরে রাখতে পেরেছে৷ সেপ্টেম্বরে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবাসী আয় বেড়েছে ২৮ দশমিক ৮৫ শতাংশ৷ আর অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে প্রবাসী আয় বেড়েছে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৬ দশমিক ৫৯ শতাংশ৷ অক্টোবর মাসে ১৬৪ কোটি ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা৷
এ প্রসঙ্গে নাজনীন আহমেদ বলেন, ‘‘শুধু প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভর করে তো আর পুরো অর্থনীতি চলবে না৷ পোশাক খাতে বিশ্বমন্দা পরিস্থিতির ধাক্কা লাগছে৷ প্রায় সব ক্ষেত্রেই অর্থনৈতিক সূচকের নিম্নগতি৷ এখনই আমরা সতর্ক না হলে আমাদের অর্থনীতির বড় ধরনের সংকট হতে পারে৷’’
আহসান এইচ মনসুরও মনে করেন, ‘‘এখন বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন৷ সেটা না করলে আমরা মন্দায় পড়ে যেতে পারি৷ আমার কাছে যে হিসাব রয়েছে তাতে অর্থনীতির সূচকগুলো এখন খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছে৷’’