ক্রীড়া ডেস্ক: মহানাটকীয়তার শ্বাসরুদ্ধ বিশ্বকাপ ফাইনাল তার আঁচলে যে এত বিস্ময় লুকিয়ে রাখবে তা কে জানত ? ১৪জুলাই লর্ডসে সুপার ওভারে গড়ানো ফাইনালের সূর্যাস্ত হল ইংল্যান্ডের অবিশ্বাস্য নাটকীয় জয়ের মধ্য দিয়ে। তার আগে ম্যাচ টাই। রোমাঞ্চকর ফাইনালে টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে নিউজিল্যান্ডের ২৪১ রানের জবাবে ইংল্যান্ডও ২৪১ করে।
তাই সুপার ওভারের আগমন। সেখানেও রোমাঞ্চের তীব্র দুলুনি শেষে আবার টাই। দু’দলের রান সমান ১৫। শেষ পর্যন্ত দু’দলকে আলাদা করল বাউন্ডারির সংখ্যা। সুপার ওভারসহ ম্যাচে বেশি বাউন্ডারি মেরে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ জিতল ইংল্যান্ড। সমানে সমান লড়াই করেও ক্রিকেট আইনের নিষ্ঠুর নিয়মের বলি টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালের মঞ্চ থেকে শূন্য হাতে ফিরতে হল নিউজিল্যান্ডকে।
বহু আরাধ্য বিশ্বকাপ ট্রফি দৃষ্টির সীমায় এসেও ধরা দিল না কিউইদের হাতে। শিরোপার বদলে টুর্নামেন্ট সেরার সান্ত্বনা পুরস্কার পেলেন নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন। অন্যদিকে এর আগে তিনবার ফাইনালে হারা ইংল্যান্ড অবশেষে বিশ্বকাপ জিতল নিজেদের আঙ্গিনায়।
২৩ বছর পর নতুন চ্যাম্পিয়ন পেল বিশ্বকাপ ক্রিকেট। তবে এবারের ফাইনালে সত্যিকারের বিজয়ী ক্রিকেট। টুর্নামেন্টের ৪৪ বছরের ইতিহাসে এমন রোমাঞ্চকর ফাইনাল আর দেখেনি বিশ্বকাপ। ক্রিকেট তার অনিশ্চয়তা ও সৌন্দর্যের সবটুকুই যেন মেলে ধরেছিল লর্ডসের ফাইনালে।
শেষ অঙ্কে বাউন্ডারির হিসাবে বিজয়ী-পরাজিত নির্ধারণের আগে পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা ম্যাচের ভাগ্য বদল হয়েছে ক্ষণে ক্ষণে। সুপার ওভারসহ ম্যাচে ইংলিশদের ৪/৬ ছিল মোট ২৬টি এবং নিউজিল্যান্ডের ১৭টি। ট্রফির ভাগ্য লেখা হয়েছে এখানেই। এই প্রথম কোনো বিশ্বকাপ ফাইনাল গড়াল সুপার ওভারে।
প্রথমে ৮ উইকেটে ২৪১ রান করেছিল নিউজিল্যান্ড। জবাবে শেষ ওভারে জয়ের জন্য ইংল্যান্ডের দরকার ছিল ১৫ রান। স্বাগতিকরা নিতে পারে ১৪ রান। ম্যাচ টাই। সুপার ওভারে ইংল্যান্ডের পক্ষে ব্যাটিংয়ে জস বাটলার ও বেন স্টোকস তোলেন ১৫ রান।
ইংল্যান্ড মূল ম্যাচে যেভাবে শেষ ওভারে ব্যাট করেছে, নিউজিল্যান্ডের সুপার ওভারেও হল তেমন। শেষ দুই বলে লাগত তিন রান, শেষ বলে দুই। গাপটিল ও নিশাম এক রান নিলেন ভালোভাবে, দ্বিতীয় রান নিতে গিয়েই গাপটিল রান আউট! আবারও টাই। ট্রফির নিষ্পত্তি রানে বা উইকেটে হল না, হল বাউন্ডারি দিয়ে।
নিউজিল্যান্ডে জন্ম নেয়া বেন স্টোকস ম্যাচসেরা হয়ে হারালেন নিউজিল্যান্ডকেই। মূল ম্যাচে শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ডের আশা জিইয়ে রেখেছিলেন স্টোকসই। শেষ পর্যন্ত তিনি অপরাজিত থাকেন ৮৪ রানে। সুপার ওভারেও দলের ১৫ রানের ৮ রান আসে তার ব্যাট থেকে।
৪৯তম ওভারে স্টোকসের ক্যাচ মিড উইকেটে হাতে নিয়েও বাউন্ডারির বাইরে চলে যান বোল্ট। ম্যাচও যেন সঙ্গে বাইরে নিয়ে গেলেন। শেষ ওভারে আরেকটি ট্র্যাজেডির শিকার কিউইরা। জয়ের জন্য শেষ তিন বলে ইংল্যান্ডের দরকার ছিল আট রান। শেষ ওভারের চতুর্থ বলে গাপটিলের থ্রো লাগল স্টোকসের ব্যাটে, হল চার।
আগেই দৌড়ে দুই রান নেয়ার সুবাদে এলো মোট ছয় রান। ম্যাচ কার্যত সেখানেই নিউজিল্যান্ডের মুঠো থেকে বেরিয়ে যায়। তবুও শেষ দুই বলে দুই রান দিয়ে ম্যাচটি সুপার ওভারে নিয়ে যান বোল্ট। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
বিশ্বকাপে প্রথম পর্বের নয় ইনিংসের ছয়টিতেই তিনশ’ ছাড়ানো স্কোর ছিল ইংল্যান্ডের। ফাইনালে তাদের সামনে লক্ষ্য ২৪২! মামুলি ভেবে অনেকেই ইংল্যান্ড ব্যাটিংয়ে নামার আগেই হয়তো তাদের হাতে বিশ্বকাপ ট্রফি দেখে ফেলেছিল। বিশ্বকাপে আক্রমণই ছিল ইংল্যান্ডের মূল অস্ত্র।
অন্যদিকে কেন উইলিয়ামসনদের সাফল্যের মন্ত্র প্রতিরক্ষা। ব্যাটসম্যানদের বিশ্বকাপে কিউইরা দেখিয়েছে ব্যাটিং স্বর্গেও শৃঙ্খল বোলিংয়ে ম্যাচ হতে পারে বোলারদের। যাদের জন্য তিনশ’ ছাড়ানো স্কোর করা মামুলি ব্যাপার, সেই ইংল্যান্ডকে ম্যাচে টিকে থাকতেই রীতিমতো কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।
৮৬ রানে চার উইকেট হারানো ইংল্যান্ডকে ম্যাচে ফেরান জস বাটলার (৫৯) ও স্টোকস। পঞ্চম উইকেটে তাদের ১১০ রানের জুটি ভাঙার পর কার্যত একার কাঁধেই সব দায়িত্ব তুলে নেন স্টোকস।
বিশ্বকাপের শুরু থেকেই সব ম্যাচে মাঠের এক কোনায় বড় চুলওয়ালা গিটারিস্টের জন্য আলাদা জায়গা রাখা হয়েছিল। তার এক গিটারেই কখনও ব্যান্ডের মাতাল সুর আবার কখনও পিয়ানোর বেদনার সুর উঠেছে। ফাইনালেও প্রেসবক্সের ডান পাশে একই গিটারে দুই সুর তুলে গেলেন সেই গিটারিস্ট। আসরের শেষদিনে তাতে বিরহের সুরই বেশি মিশে থাকল। দেড় মাসেরও বেশি সময়ের টুর্নামেন্ট কবে শুরু হয়েছিল, সেটা অনেকেই ভুলে গেছেন। শেষটা হল টুর্নামেন্টের ক্রিকেট তীর্থ লর্ডসে। রোববার সকালে হালকা বৃষ্টির কারণে ফাইনাল ১৫ মিনিট দেরিতে শুরু হয়। এরপর সারা দিন মেঘ-সূর্যের খেলা চলতে থাকে। গুমোট আবহাওয়া আর কাটেনি।
মেঘলা কন্ডিশনে আগুন ঝরালেন বোলাররা। টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে হেনরি নিকোলসের (৫৫) ফিফটি ও টম লাথামের ৪৭ রানের লড়াকু ইনিংসের সুবাদে আট উইকেটে ২৪১ রান তোলে নিউজিল্যান্ড। দারুণ বোলিংয়ে কিউই ব্যাটসম্যানদের ডানা মেলতে দেননি ইংল্যান্ডের বোলাররা।
ক্রিস ওকস ও লিয়াম প্লাংকেট নেন ৩টি করে উইকেট। পুরো টুর্নামেন্টেই মাঝারি পুঁজি নিয়ে বাজিমাত করেছে নিউজিল্যান্ড। ভারতের বিপক্ষে সেমিফাইনালে তারা করেছিল ২৩৯। ফাইনালে তার চেয়ে দুই রান বেশি তুলতে পারলেও এবার ভাগ্যের কাছে হারতে হয়েছে কিউইদের।
গত বিশ্বকাপে আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের প্রদর্শনীতে মার্টিন গাপটিল ৫৪৭ রান করে হয়েছিলেন টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহকও। এবারও কিউইদের বাজি ছিলেন তিনি। তবে ইংল্যান্ডে তার ব্যাট একেবারেই নিষ্প্রভ থাকল। ফাইনালে গাপটিলের শুরুটা হয়েছিল দারুণ।
তাকে হতাশায় পোড়ান সেমিফাইনালের সেরা বোলার ক্রিস ওকস। এলবিডব্লু হয়ে রিভিউ নিয়েও বাঁচতে পারেননি গাপটিল। ড্রেসিংরুমে ফেরেন ১৮ বলে ১৯ করে। দলীয় স্কোর তখন ২৯/১। তার আগে শূন্যতে আউট হয়েও রিভিউ নিয়ে বেঁচে যান নিকোলস। দ্বিতীয় উইকেটে নিকোলস ও উইলিয়ামসন গড়েন ৭৪ রানের জুটি।
পুরো টুর্নামেন্টে কিউইদের ব্যাটিংয়ের মূল শক্তি উইলিয়ামসন ফেরেন ৩০ রান করে। এরপর নিয়মিত বিরতিতেই উইকেট হারিয়েছে তারা। উইলিয়ামসন বিদায়ের পর ১৫ রানের মধ্যে ফেরেন নিকোলসও। প্লাংকেটের বলে বোল্ড হওয়ার আগে ৭৭ বলে করেন ৫৫ রান।
মিডল অর্ডারে উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান টম লাথাম যা একটু ভালো ব্যাটিং করেছেন। বাকিরা শুরুটা ভালো করেই ফিরেছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান করা লাথাম ফেরেন নয় বল বাকি থাকতে ৪৭ রান করে।
ইংল্যান্ডের মূল পাঁচ বোলারই ইকোনমি রেট পাঁচের নিচে রেখে বোলিং করেছেন। নতুন বলে সুইং আর গতির প্রদর্শনীতে ফাইনালে ইংলিশদের সেরা বোলার ওকস। মাত্র ৩৭ রানে নিয়েছেন তিন উইকেট। সমান তিনটি উইকেট পাওয়া প্লাংকেট ১০ ওভারে দিয়েছেন ৪২ রান।