Search

শনিবার, ৬ই সেপ্টেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শনিবার, ৬ই সেপ্টেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ শনিবার, ৬ই সেপ্টেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২২শে ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৩ই রবিউল আউয়াল ১৪৪৭ হিজরি

উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ ১২টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন

জামিন নামঞ্জুর, সাংবাদিক শামসুজ্জামান কারাগারে

সম্পাদক মতিউর রহমানের গ্রেফতারের দাবিতে বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ মিছিল ও শাহবাগ মোড় অবরোধ

সাভারে কর্মরত দৈনিক প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় বৃহস্পতিবার(৩০ মার্চ) জামিন আবেদন করলে তা নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। একই মামলায় প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও একজন সহযোগী ক্যামেরাম্যানকে আসামি করা হয়।

প্রথম আলো অনলাইন ইলেকট্রনিক মিডিয়া ব্যবহার করে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন ও অপপ্রচারের অভিযোগে বুধবার(২৯ মার্চ) রাতে রমনা থানায় এ মামলা করা হয়েছে। মামলাটি করেন একজন আইনজীবী।

এছাড়া একই দিন যুবলীগের এক নেতা বাদী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তেজগাঁও থানায় শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে আরেকটি মামলা করেন। এদিকে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান ও নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন সংগঠন দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেছে।

আর বাংলাদেশে সাংবাদিকদের ওপর সহিংসতা ও ভীতি প্রদর্শনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রসহ ১২টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন। মামলা ও গ্রেফতারের নিন্দা করে বিবৃতি দিয়েছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি), নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব), সম্পাদক পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন।

একই ঘটনায় আরও মামলা হতে পারে-এমন আভাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। আইনমন্ত্রী জানিয়েছেন, শামসুজ্জামানকে গ্রেফতারের ঘটনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার হয়নি। তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, প্রথম আলোর সংবাদ স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করেছে। রাষ্ট্রের মূল ভিত্তিমূলে আঘাত হানা হয়েছে। এদিকে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রথম আলো কার্যালয়ের সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করেছে পুলিশ।

বৃহস্পতিবার সকালে শামসুজ্জামানকে আদালতে হাজির করা হয়। দুপুরের পর তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক তোফাজ্জল হোসেন। শামসুজ্জামান জামিনে মুক্তি পেলে তদন্তে বিঘ্ন ঘটতে পারে উল্লেখ করে তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও রমনা মডেল থানার পরিদর্শক আবু আনছার। এ মামলায় জামিন চেয়ে আবেদন করেন শামসুজ্জামানের আইনজীবী প্রশান্ত কুমার কর্মকার। বিচারক জামিনের আবেদন খারিজ করে আসামিকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

বুধবার রাত ১১টার দিকে অ্যাডভোকেট আবদুল মশিউর মালেক বাদী হয়ে রাজধানীর রমনা থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এই মামলা করেন। এর আগে একদিনে সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া (৩৬) নামে এক যুবলীগ নেতা বাদী হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তেজগাঁও থানায় শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে অপর একটি মামলা করেন। এই মামলা দায়েরের ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে বুধবার ভোর সাড়ে ৪টার দিকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিচয়ে কিছু লোক শামসুজ্জামানকে তার সাভারের (জাবি সংলগ্ন) বাসা থেকে তুলে নেয়। স্থানীয় পুলিশ জানায়, তারা এ বিষয়ে কিছু জানে না। এর প্রায় ৩০ ঘণ্টা পর বৃহস্পতিবার তাকে আদালতে তোলা হয়।

শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুটি মামলা হলেও তাকে রমনা থানার মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়েছে। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে আরও মামলা হচ্ছে। বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি সাংবাদিকদের জানান, প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানের নামে আমরা এখন পর্যন্ত দুই-তিনটির (মামলার) খবর জানি। আরও মামলা হচ্ছে বলে আমরা শুনেছি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি এখন বলতে চাই, প্রাথমিকভাবে যে তথ্য ৭১ টিভি ও প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকায় বা মিডিয়ায় আসছে, সেগুলো জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সিআইডি তাকে নিয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে ছেড়েও দিয়েছে। এরপর বেশ কয়েকটি মামলা বিভিন্ন স্থানে হয়েছে, সে মামলার ভিত্তিতে তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়েছে। আমরা এখন পর্যন্ত দুই-তিনটির খবর জানি।’

বৃহস্পতিবার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ‘সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপনে বঙ্গবন্ধু’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, ‘বাসন্তীকে জাল পরিয়ে বানোয়াট সংবাদ পরিবেশনের মতো একটি শিশুকে ১০ টাকা দিয়ে তার নাম ব্যবহার করে অসত্য লিখে স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করা কি অপরাধ নয়?’ এটি কি সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতার পরিপন্থি নয়? সেজন্যই এটার প্রচণ্ড সমালোচনা হয়েছে, এটি ঠিক নয় বিধায় আপলোড হওয়ার পর সেটি তারা সরিয়েও ফেলেছিল। কিন্তু সেটির ‘স্ক্রিনশট’ তো বিভিন্ন জায়গায় ছিল, অনেকে শেয়ার করেছে, সেগুলো রয়েও গেছে। সেগুলো সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরে বেড়িয়েছে, ঘুরছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা মামলা করেছে, মামলার পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিককে গ্রেফতারও করা হয়েছে। পুলিশের তদন্তে সব বেরিয়ে আসবে এবং আইনের গতিতে আইন চলবে।’

সম্প্রচারমন্ত্রী বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার আগে বাসন্তীর গায়ে জাল পরিয়ে ছবি তুলে সেটি প্রকাশ করা হয়েছিল। তখন জালের দাম কিন্তু কাপড়ের দামের চেয়ে বেশি ছিল, এখনো জালের অনেক দাম। কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে বাসন্তীর গায়ে জাল পরিয়ে ছবি তুলে প্রকাশ করা হয়েছিল। অনেকে বলছে, ২৬ মার্চে প্রথম আলোর এ ঘটনাটি বাসন্তীকে জাল পরানোর মতোই। রাষ্ট্র, সমাজ, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এ ধরনের অসত্য পরিবেশন সর্বমহলের মতে একটি অপরাধ, ডিজিটাল অপরাধ।’

অপরাধ আর সাংবাদিকতা এক জিনিস নয় উল্লেখ করে মন্ত্রী হাছান মাহমুদ বলেন, ‘কোনো সাংবাদিক যদি অপরাধ করে, তার কি শাস্তি হবে না? কেউ যদি অপসাংবাদিকতা করে, স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করে এবং একটি ছেলের হাতে ১০ টাকা ধরিয়ে দিয়ে তার নামে অসত্য লেখে, চাইল্ড এক্সপ্লয়টেশন করে, সেটার কি বিচার হবে না? আমরা কি কেউ বিচারের ঊর্ধ্বে, আইনের ঊর্ধ্বে? তা তো নয়।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশে মতপ্রকাশের যে স্বাধীনতা, সেটি অনেক উন্নয়নশীল দেশে নেই। আপনারা যদি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন হচ্ছে সমগ্র দেশের সব মানুষের ডিজিটাল নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য, সাংবাদিকদেরও ডিজিটাল নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে অনেক সাংবাদিকও মামলা করেছে। কদিন আগে একজন নারী সাংবাদিক বিদেশ থেকে চরিত্রহননের দায়ে আরেক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।’

বিশ্বের দেশে দেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের উদাহরণ দিয়ে ড. হাছান বলেন, ‘এ ধরনের আইন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হয়েছে। যুক্তরাজ্যে সাইবার সিকিউরিটি ল’জ অ্যান্ড রেগুলেশন ২০২২, যুক্তরাষ্ট্রে সাইবার ল অ্যান্ড পানিশমেন্ট এবং এ ধরনের আইন বিশ্বের বহু দেশে রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের অপরাধের শাস্তি হচ্ছে ২০ বছর কারাদণ্ড।

এবং ডিজিটাল মাধ্যমে গুজব ছড়ানোর কারণে যদি কারও মৃত্যু হয় তবে সেই ডিজিটাল অপরাধের শাস্তি হচ্ছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আমাদের দেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য অনেক দেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অনেক বেশি কঠিন।’

সাংবাদিকদের অপর এক প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেন, ‘এ ঘটনায় অবশ্যই রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে আঘাত হানা হয়েছে, স্বাধীনতাকে কটাক্ষ করা হয়েছে। স্বাধীনতা দিবসের দিন জাতীয় স্মৃতিসৌধ যেটি আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক, সেখানে একটা ছেলেকে ১০ টাকা দিয়ে ফুসলিয়ে তাকে দিয়ে কথা বলানোর চেষ্টা করা হয়েছে এবং সে যেটি বলেনি, সেটা প্রচার করা হয়েছে। এটি ঠিক হয়নি বলেই তারা সরিয়েছে। সুতরাং অবশ্যই এখানে রাষ্ট্রের ওপর আঘাত হানা হয়েছে।’ একই দিন সচিবালয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, যে মামলা করা হয়েছে, সেটা হচ্ছে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে নয়, এটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আপনারা নির্ভীক সাংবাদিক আমি স্বীকার করি। যদি সত্য তথ্য প্রকাশ করেন, তাহলে কোনোমতেই এই সরকার সাংবাদিকদের বাধা দেবে না।

তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা অপূর্ব হাসান জানিয়েছেন, রাজধানীর কাওরানবাজারে দৈনিক প্রথম আলোর কার্যালয়ের সামনে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় একটি খবরকে কেন্দ্র করে বেশ কয়েকটি সংগঠন প্রতিবাদ জানিয়ে মানববন্ধন করতে চেয়েছিল। আমরা তা করতে দিইনি। সকাল থেকে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।

এদিকে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের গ্রেফতারের দাবিতে বৃহস্পতিবার বিক্ষোভ মিছিল ও শাহবাগ মোড় অবরোধ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) একদল শিক্ষার্থী। সাধারণ শিক্ষার্থীর ব্যানারে করলেও এতে অবস্থান নেন বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন হল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করে শাহবাগ মোড়ের গোলচত্বরে অবরোধ করে অবস্থান নেন তারা। বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত শাহবাগ গোল চত্বরে অবস্থান করেন। এরপর তারা সড়ক অবরোধ ছেড়ে দেন। এতে সড়কে সাময়িক দুর্ভোগও সৃষ্টি হয়।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Telegram
WhatsApp
Email
Print