
বিবাহ ও তালাক নিবন্ধনের ক্ষেত্রে কাজিদের দায়িত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখের বিষয় হলো, যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে কাজি অফিস পরিচালনা করা হয় না।
যেসব সহকারী দিয়ে কাজ নেওয়া হয়, রাষ্ট্রীয় আইন বা শরিয়তের বিধিবিধান বিষয়ে তাদের তেমন কোনো পড়াশোনা থাকে না। ফলে অনেক ভুল-ভ্রান্তি হয়ে থাকে। তা ছাড়া কাজি অফিসে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের ফরম সঠিক নিয়মে তৈরি থাকে না, ফলে শুদ্ধ লিখতে চাইলেও সম্ভব হয় না।
আবার সংক্ষেপে কাজ করতে গিয়ে একই ফরমে অবলিক দিয়ে দিয়ে অনেকগুলো অপশন রাখা হয়, কিন্তু ঘর পূরণের সময় সেখানে উদ্দিষ্ট ঘরে টিক দেওয়া হয় না। এ ধরনের অনেক অবহেলা লক্ষ করা যায়। নিম্নে কাজি অফিসের ভুলের কিছু নমুনা চিহ্নিত করে দেওয়া হলো :
ভুল ১: শরিয়তসম্মত সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে বিয়ে পড়ানো:
সাধারণত শুধু ছেলে- মেয়ের পছন্দের বিয়ে অথবা কাজি অফিসে গোপন বিয়ের ক্ষেত্রে এ ভুলটি হয়ে থাকে। বিয়ের মজলিসে যদি বর-কনে উপস্থিত থাকে তাহলে সেখানে সাক্ষী হিসেবে দুজন পুরুষ কিংবা দুজন নারী ও একজন পুরুষ উপস্থিত থাকা আবশ্যক। এর ব্যতিক্রম হলে বিয়ে শুদ্ধ হবে না। ( দেখুন : সুনানে তিরমিজি : হাদিস ১১০৩)
আর যদি বর-কনের স্থলে তাদের প্রতিনিধি/উকিল উপস্থিত থাকে তাহলে ওই উকিল ছাড়া সাক্ষীদের সংখ্যা পুরা হতে হবে। তা ছাড়া এ ধরনের গোপন বিয়ে বা কোর্টম্যারেজে অনেক সময় অপরিচিত লোকদের সাক্ষী বানানো হয়। এতে সাক্ষীর শর্ত পূরণ হলেও পরবর্তী সময়ে কখনো সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের প্রয়োজন হলে তাদের উপস্থিত করা সম্ভব হয় না। তাই এ পদ্ধতিটি পরিহার করা আবশ্যক।
ভুল ২: মুখে কবুল না বলিয়ে কাবিননামায় বর-কনের স্বাক্ষর নেওয়া:
অনেক সময় মুখে ইজাব-কবুল না পড়িয়ে এফিডেভিট বা নিকাহনামায় বর-কনের স্বাক্ষর নেওয়ার মাধ্যমে বিবাহ সম্পন্ন করা হয়। বিশেষ করে কোর্টম্যারেজের ক্ষেত্রে এটা হয়ে থাকে। আবার ইজাব-কবুল হলেও শরিয়তসম্মত পন্থায় উচ্চারণ হয় না। এ ধরনের এফিডেভিট বা কাবিন দ্বারা বিয়ে শুদ্ধ হবে না। বিয়ে শুদ্ধ হওয়ার জন্য সঠিকভাবে মুখে ইজাব-কবুল পড়ানো অন্যতম শর্ত। (রদ্দুল মুহতার ৩/১২, ফাতাওয়ায়ে হক্কানিয়া ৪/৩১৫)
ভুল ৩: তালাকের অধিকার প্রদানে শর্তগুলোকে অবিবেচক গতবাঁধা লিখে দেওয়া:
কাবিননামার ১৮ নম্বর ধারায় লেখা আছে, কী কী শর্তে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অপর্ণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে যেসব শর্তসাপেক্ষে স্ত্রীকে তালাকের ক্ষমতা প্রদান করা হয়ে থাকে, সাধারণত সেগুলো কাজিরা অবিবেচনা প্রসূত গতবাঁধা ও অস্পষ্টভাবে লিখে দেয়। এ ব্যাপারে ছেলে বা মেয়েপক্ষের মতামত নেওয়া বা শর্তগুলো সুচিন্তিতভাবে লেখার চেষ্টা করা হয় না।
অনেক সময় তালাকের ক্ষমতা অর্পণের সময় শুধু ‘বনিবনা না হলে’ শর্তটি উল্লেখ করা হয়। অথচ বনিবনার বিষয়টি ব্যাখ্যাসাপেক্ষ। এর কোনো ব্যাখ্যা না দিয়ে গতবাঁধা তা লিখে দেওয়া হয়। ফলে পরবর্তী সময়ে স্ত্রী সামান্য মনোমালিন্য বা ভালো না লাগকে বনিবনা হচ্ছে না বলে তালাকের ক্ষমতা প্রয়োগ করে। অথচ এ ধরনের সামান্য মনোমালিন্য বনিবনা না হওয়ার মধ্যে পড়ে না। কাজেই কথাটি ঢালাওভাবে না লিখে বিস্তারিত লিখতে হবে। যাতে পরবর্তী সময়ে কোনোরূপ অস্পষ্টতা দেখা না দেয়। এতে বর-কনে উভয়ের কল্যাণের বিষয়টি তুলে ধরতে হবে। যাতে ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে স্ত্রী নিজেকে মুক্ত করে নিতে পারে।
১৮ নং ধারা পূরণের একটি সঠিক নমুনা:
এ ক্ষেত্রে উভয়ের স্বার্থ রক্ষা হওয়ার মতো করে কিছু শর্ত ঠিক করে তালাকের ক্ষমতা অর্পণ করতে হবে। নিম্নে সঠিক পদ্ধতিতে ১৮ নম্বর ধারা পূরণের একটি নমুনা পেশ করা হলো। ১৮ নম্বর ধারায় লেখা আছে-স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করিয়াছে কি না? করিয়া থাকিলে কী কী শর্তে? তাই লিখতে হবে : ‘স্বামী নিয়মিত স্ত্রীর খোরপোষ ও বাসস্থানসহ যাবতীয় অধিকার আদায় না করলে বা দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকলে, অথবা স্ত্রী শ্বশুরালয়ে অসহ্য নির্যাতনের শিকার হলে কিংবা স্বামী-স্ত্রীর চরম পর্যায়ের বিরোধ হলে এবং এ ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে মীমাংসা সফল না হলে স্ত্রী স্বীয় অভিভাবকের পরামর্শক্রমে যখন ইচ্ছা নিজের ওপর এক তালাকে বায়েন গ্রহণ করতে পারবে।’
উক্ত পদ্ধতিতে ধারাটি পূরণ করা হলে আশা করি জটিলতা থাকবে না এবং কারো ওপর অন্যায় বা জুলুম হবে না। উল্লেখ্য যে এটি নমুনাস্বরূপ দেওয়া হলো। তাই নিজ নিজ পরিস্থিতি ও সুবিধা অনুসারে শর্তাবলিতে কম-বেশি বা সংযোজন-বিয়োজন করে নিতে পারবে।
ভুল ৪ : ১৮ নম্বর ধারায় শুধু ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ শব্দ লেখা:
অনেকে কাবিননামার ১৮ নম্বর ধারায় শুধু ‘হ্যাঁ’ শব্দটি লিখে দেয়। এটাও ভুল। কেননা এতে স্ত্রী নিঃশর্তভাবে তালাক গ্রহণের ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়। আর স্ত্রীকে তালাক গ্রহণের ক্ষমতা প্রদান যদিও শর্তযুক্ত বা শর্তহীন দুভাবেই হতে পারে; কিন্তু নিঃশর্ত ক্ষমতা প্রদানের ক্ষেত্রে যেহেতু ঝুঁকি আছে, তাই এমনটি করা আদৌ ঠিক নয়; বরং তা ভারসাম্যপূর্ণ শর্তযুক্ত করাই বাঞ্ছনীয়। আবার অনেক সময় পাত্রপক্ষ শুধু ‘না’ শব্দ লিখে দেয়। পাত্রীপক্ষ তাতে দ্বিমতও করে না। বর্তমান ফেতনা-ফ্যাসাদের যুগে এটাও মারাত্মক ভুল। কেননা এতে স্বামীকর্তৃক স্ত্রীর ওপর জুলুম হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
ভুল ৫ : তিন তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণ করা:
কাজি বা বিবাহ রেজিস্টারারগণ অনেক ক্ষেত্রেই এ ধারার ঘরে ‘তিন তালাক গ্রহণের ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে’ লিখে দেয়। এটি অনেক বড় ভুল। কারণ এক তালাকে বায়েন গ্রহণের ক্ষমতা অপর্ণ করা হলেই এ ধারার উদ্দেশ্য পরিপূর্ণরূপে হাসিল হয়ে যায়। কিন্তু বিবাহ রেজিস্টারার বা কাজি এ দিকটি বিবেচনা না করেই তিন তালাকের অধিকারের কথা লিখে ফেলে। ফলে এ ক্ষমতাবলে পরবর্তী সময়ে স্ত্রী যখন সামান্য কারণেই তিন তালাক গ্রহণ করে বসে এবং এরপর আবার ওই স্বামীর সঙ্গে ঘর-সংসার করতে চায়; তখন আর সেই সুযোগ বাকি থাকে না।
ভুল ৬ : তালাক অর্পণের ধারা পূরণ না করে স্বাক্ষর গ্রহণ:
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কাজি সাহেব বর-কনের তথ্য, সাক্ষীদের নাম-ঠিকানা, মোহরানা ইত্যাদি বিষয়গুলো রাফ খাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখেন। অফিসে গিয়ে কাবিননামার মূল ভলিয়মে তোলেন। আর বিয়ের মজলিসে কাবিননামার ভলিয়ম খালি অবস্থায়ই বর-কনেসহ অন্যদের স্বাক্ষর নিয়ে নেন। ফলে ১৮ নম্বর ধারাটিও খালি থাকে, সেখানে ক্ষমতা অর্পণের বিষয়ে কিছু লেখা থাকে না। এ অবস্থায় কলামটি খালি রেখে স্বামীর স্বাক্ষর নিলে ‘তাফবিজে তালাক’ তথা তালাকের ক্ষমতা অর্পণ শুদ্ধ হবে না। কাজি সাহেব অফিসে গিয়ে এই কলামে নিজের পক্ষ থেকে তাফবিজের সিল মেরে দিলে তা কার্যকর হবে না। ফলে এর ভিত্তিতে ভবিষ্যতে স্ত্রী ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্যত্র বিয়ে বসলে আজীবন গুনাহে লিপ্ত থাকবে। যার দায় কাজি সাহেব এড়াতে পারেন না। তাই বিয়ের মজলিসে সময় কম থাকলে কমপক্ষে ১৮ নম্বর ধারাটি পূরণ করে তবেই স্বামীর কাছ থেকে স্বাক্ষর নিতে হবে। এ ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন অতীব জরুরি।
ভুল ৭ : বিবাহের আগেই কাবিন করে ফেলা:
প্রায়ই দেখা যায়, বিয়ের আগেই অনেকে কাবিন করে রাখে। আবার অনেক সময় সরকারি কাজি বিবাহের মজলিসে ইজাব-কবুল সংঘটিত হওয়ার আগেই সময় না থাকা বা অন্য কোনো কারণ দেখিয়ে কাবিনের ফরম পূরণ করে ফেলে এবং বর-কনে ও সাক্ষীদের স্বাক্ষর নিয়ে নেয়। এটা অত্যন্ত ভুল কাজ। কেননা কাবিননামা হলো, প্রচলিত আইন অনুসারে বিবাহের নিবন্ধন। তাই শরিয়তের বিধান হলো, কাবিন করতে হলে আগে নিয়মমাফিক বিবাহ সম্পন্ন করতে হবে। তারপর নির্ধারিত কাবিননামার ফরম পূরণ করবে।
এ ক্ষেত্রে কিছু বড় সমস্যা রয়েছে। যেমন—কাবিননামার ফরমে অনেকগুলো ধারা রয়েছে। তার মধ্যে কয়েকটি হলো, কত তারিখে বিবাহ সম্পাদিত হয়েছে? কোথায় বিবাহ পড়ানো হয়েছে? বিবাহ কে পড়িয়েছেন? বিবাহ পড়ানো ছাড়া কাবিন করা হলে ফরমের এ ধারাগুলোতে মিথ্যা তথ্য লিখতে হয়। কেননা বিবাহ না হওয়ায় বিবাহ সম্পাদনের তারিখ, স্থান ও যিনি বিবাহ পড়িয়েছেন—সব কিছু লিখতে হবে।
ভুল ৮ : কাবিননামার ১৯ নম্বর ধারার কার্যকারিতা:
কাবিননামার ১৯ নম্বর ধারায় আছে—‘স্বামীর তালাক প্রদানের অধিকার খর্ব করা হয়েছে কি না?’ এ ধারাটি একটি অনর্থক ধারা। কেননা এর কোনো কার্যকারিতা নেই। স্বামীর তালাক প্রদানের অধিকার খর্ব হওয়ার সম্মতিমূলক স্বাক্ষর দিলেও স্বামীর তালাক প্রদানের অধিকার কখনো খর্ব হয় না। কেননা এটি ইসলামপ্রদত্ত অধিকার।
লেখক: শিক্ষক, ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার, বসুন্ধরা