
প্রভাতী ডেস্ক : রাত ২টা ৩৪ মিনিটে রাজধানীর ডেমরার সুলতানা কামাল ব্রিজের প্রায় মাঝখানে আসেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ। এসময় তার মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্রিজের ঠিক মাঝ বরাবর দেখা যায়। ব্রিজের তারাবো প্রান্ত থেকে মাঝখান পর্যন্ত দূরত্ব ৪০০ থেকে ৫০০ মিটার। রাত ২টা ৩৪ মিনিট ৯ সেকেন্ডে সুলতানা কামাল ব্রিজের রেলিং ক্রস করেন ফারদিন।
প্রযুক্তি সহায়তায় ফারদিনের মোবাইল লোকেশন ও সিসিটিভি ফুটেজের ভিডিও একই সময়ে তাকে শনাক্ত করা হয়। রাত ২টা ৩৫ মিনিট ৯ সেকেন্ডে ফারদিনের মোবাইল সিম স্লটে পানি ঢুকে নেটওয়ার্ক অকার্যকর হয়ে পড়ে। সেটি পরবর্তী সময়ে প্রযুক্তির মাধ্যমে নিশ্চিত হওয়া যায়।
পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে প্রযুক্তির মাধ্যমে পাওয়া তথ্য, বিভিন্ন আলামতের ফাইন্ডিংস ও সিসিটিভি ফুটেজের দৃশ্য সময় ও লোকেশন সম্পূর্ণভাবে মিলে যায়। এজন্য ছায়াতদন্তকারী সংস্থা পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাবের দাবি, ফারদিন স্বেচ্ছায় ব্রিজ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ফারদিনের মোবাইল নম্বরের আইপিডিআর (ইন্টারনেট প্রটোকল ডিটেইলস রেকর্ড) বিশ্লেষণে এসব তথ্য জানা গেছে।
বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশ বুয়েটে ভর্তির পর তার প্রথম সেমিস্টারে রেজাল্ট ছিল ৩.১৬। আর মারা যাওয়ার আগের সেমিস্টার অর্থাৎ সর্বশেষ সেমিস্টারের রেজাল্ট ছিল ২.৩১। সবশেষ গত কয়েক সেমিস্টারে তার রেজাল্ট খারাপের দিকে যায়। এটি বাসার লোকজন বা আত্মীয়স্বজন কেউ জানতেন না।
ফারদিন নূর পরশ হত্যা মামলার তদন্ত নতুন মোড় নিয়েছে। তিনি ‘আত্মহত্যা’ করেছেন বলে দাবি করছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও ছায়া তদন্তকারী সংস্থা র্যাব।
তদন্ত সংস্থার দাবি, পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়া ও বিদেশ যেতে অর্থ জোগাড় করতে না পারাসহ বেশ কিছু হতাশা থেকে এই তরুণ স্বেচ্ছায় আত্মহননের পথ বেছে নেন।
এর আগে ফারদিনের বাবা কাজী নূর উদ্দিন বলেছিলেন, ফারদিন আত্মহত্যা করতে পারে না। তার দাবি- ‘এটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।’
‘আমি হাসিমুখে আত্মহত্যা করবো’: ফারদিন
ফারদিন নূর পরশ কয়েক বছর একজন মেয়ের সঙ্গে নিয়মিত চ্যাটিং করতেন। ফারদিন তার মনের কথা ওই মেয়ের সঙ্গে শেয়ার করতেন। তাদের দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তবে তদন্তের স্বার্থে ওই মেয়ের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেনি তদন্তকারী সংস্থা।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, ফারদিনের ডিজিটাল ডিভাইস পর্যালোচনা করে ও প্রযুক্তির সহায়তায় একজন মেয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চ্যাটিংয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। সেই মেয়েকে ফারদিন তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালো লাগা-মন্দ লাগার কথা শেয়ার করতেন।
অজ্ঞাতপরিচয় ওই মেয়ের সঙ্গে চ্যাটিংয়ের একপর্যায়ে ফারদিন লিখেন, ‘আমি সুখে আত্মহত্যা করবো। কত যে শান্তি যে। হাসিমুখে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে।
যেভাবে নিখোঁজ হন ফারদিন:
গত ৪ নভেম্বর বিকেল ৩টার দিকে রাজধানীর ডেমরার কোনাপাড়ার নিজ বাসা থেকে পরীক্ষার কথা বলে বুয়েটের হলের উদ্দেশ্যে বের হন ফারদিন। বিকেল আনুমানিক ৫টার দিকে তিনি সায়েন্সল্যাব মোড়ে তার পরিচিতার সঙ্গে দেখা করেন। এরপর সেখান থেকে নীলক্ষেত ও ধানমন্ডিসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করেন। পরে সাত মসজিদ রোডে একটি রেস্টুরেন্টে খাবার খেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা করেন।
রাত আনুমানিক ৮টার সময় ফারদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিসহ পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন স্থানে ঘোরাঘুরি করেন। পরে রিকশাযোগে রামপুরার উদ্দেশ্যে রওনা করেন। আনুমানিক রাত পৌনে ১০টার দিকে রামপুরা ব্রিজ এলাকায় ফারদিন রিকশা থেকে নেমে যান এবং কিছুক্ষণ রামপুরা ব্রিজ এলাকায় ঘোরাফেরা করেন।
রামপুরা থেকে জিনজিরা, পুরান ঢাকা ও গুলিস্তানে যান ফারদিন:
র্যাব জানায়, প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণে দেখা যায়, রামপুর ব্রিজ থেকে ফারদিন কেরানীগঞ্জের জিনজিরা, বাবুবাজার ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা, পুরান ঢাকার জনসন রোড ও গুলিস্তানের পাতাল মার্কেট এলাকায় যান।
যাত্রাবাড়ী থেকে লেগুনায় ১৯ মিনিটে তারাবো বিশ্বরোডের বাসস্ট্যান্ড নামেন ফারদিন-
সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণের মাধ্যমে জানা যায়, রাত ২টা ১ মিনিটে (সিসিটিভি ফুটেজ টাইম ২টা ৩ মিনিট) যাত্রাবাড়ীর বিবিরবাগিচা থেকে ফারদিনকে লেগুনায় উঠতে দেখা যায়। রাত ২টা ২০ মিনিটে সুলতানা কামাল ব্রিজের অপর পাশে তারাবো বিশ্বরোডের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় লেগুনা থেকে নেমে যান তিনি।
তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে জানা যায়, রাত ২টা ২৬ মিনিটে সুলতানা কামাল ব্রিজের তারাবো প্রান্তে ফারদিনের অবস্থান ছিল। রাত ২টা ৩৪ মিনিটে ব্রিজের প্রায় মাঝখানে আসেন। এসময় তার মোবাইল নেটওয়ার্কও ব্রিজের ঠিক মাঝ বরাবর দেখা যায়। রাত ২টা ৩৪ মিনিট ৯ সেকেন্ডে ব্রিজের রেলিং ক্রস করেন ফারদিন।
নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার ৪৮ সেকেন্ড পর মোবাইল নেটওয়ার্ক অকার্যকর:
রাত ২টা ৩৪ মিনিট ১৬ সেকেন্ডে সুলতানা কামাল ব্রিজের ওপর থেকে স্বেচ্ছায় নদীতে ঝাঁপ দেন ফারদিন। রাত ২টা ৩৪ মিনিট ২১ সেকেন্ডে শীতলক্ষ্যা নদীর পানিতে পড়েন ফারদিন। রাত ২টা ৩৫ মিনিট ৯ সেকেন্ডে ফারদিনের মোবাইল সিম স্লটে পানি ঢুকে নেটওয়ার্ক অকার্যকর হয়ে যায়। রাত ২টা ৫১ মিনিটে তার হাতের ঘড়িতে পানি ঢুকে সেটি অকার্যকর হয়ে পড়ে।
তদন্তকারী সংস্থার দাবি, ফারদিন নূর পরশ গত কয়েক বছর একজন মেয়ের সঙ্গে নিয়মিত চ্যাট করতেন। নিজের মনের কথা ওই মেয়েকে জানাতেন। তাদের দুজনের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক না থাকলেও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তবে তদন্তের স্বার্থে ওই মেয়ের নাম-পরিচয় প্রকাশ করেনি তদন্তকারী সংস্থা।
তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, ফারদিনের ডিজিটাইল ডিভাইস পর্যালোচনা করে ও প্রযুক্তির সহয়তায় একজন মেয়ের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে চ্যাটিংয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। সেই মেয়ের সঙ্গে ফারদিন তার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, ভালো লাগা-মন্দ লাগার কথা শেয়ার করতেন।