রবিবার, ১৩ই জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

রবিবার, ১৩ই জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ রবিবার, ১৩ই জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৯শে আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৭ই মহর্‌রম ১৪৪৭ হিজরি

মিতু হত্যাকাণ্ড: মাস্টারমাইন্ড মুসার দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা, অন্য আসামীদের প্রভাবমুক্ত করতে বাবুলকে স্থানান্তর

নিজস্ব প্রতিবেদক: পুরস্কার ঘোষণার ৫ বছর পরেও সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আকতারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুর কিলিং মিশনে নেতৃত্ব দেওয়া কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসার হদিস পায়নি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। ২০১৬ সালের ৬ অক্টোবর সংবাদ সম্মেলন করে মুসাকে ধরিয়ে দিতে পারলে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে বলে ঘোষণা করেন তৎকালীন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন (সিএমপি) কমিশনার ইকবাল বাহার। তবে মুসার স্ত্রী পান্না আকতার দাবি করেন, মিতু হত্যার কয়েকদিন পর আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় নগরীর বন্দর থানা এলাকার এক আত্মীয়ের বাসা থেকে মুসাকে পুলিশ গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। এরপর থেকে মুসার খোঁজ মিলছে না। মিতু হত্যার ঘটনায় নতুন করে তার বাবার মামলা এবং এ মামলার প্রধান আসামি বাবুল আকতার গ্রেফতার হওয়ার পর আবারও আলোচনায় এসেছে সেই মুসার নাম। কারণ বাবুল আকতার আগে স্বীকার না করলেও গ্রেফতারের পর পিবিআইর কাছে স্বীকার করেছেন মুসা তার সোর্স ছিলেন। কিলিং মিশন বাস্তবায়নের ৩ লাখ টাকার যে চুক্তি হয়েছিল সেই টাকা মুসাকেই পরিশোধ করা হয় বিকাশের মাধ্যমে। তাই এ মামলা প্রমাণের জন্য এখনও মুসার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে শেষ পর্যন্ত মুসার হদিস পাওয়া না গেলে সে ক্ষেত্রে মামলা প্রমাণে কোন পথে এগোতে হবে সে বিষয়টি নিয়েও ভাবছে পিবিআই।

এদিকে মিতু হত্যা মামলার প্রধান আসামি তার স্বামী বাবুল আকতারকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ফেনী জেলা কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে। জানা যায়, চট্টগ্রাম কারাগারে মিতু হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আরো চার আসামি রয়েছে। আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি না দেওয়া, মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য তাদের নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন বাবুল আকতার। মূলত এ কারণেই তাকে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে শনিবার ফেনী কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই বাবুল আকতারকে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে জানায় চট্টগ্রাম কারা কর্তৃপক্ষ।

মুসা নিখোঁজ হওয়া প্রসঙ্গে তার স্ত্রী পান্না আকতার বলেন, ‘২০১৬ সালের ২২ জুন সকালে বন্দর থানাধীন কাটগড় এলাকায় নূরনবী নামে এক ব্যক্তির বাসায় অভিযান চালায় পুলিশ। পুলিশ আমার ভাসুর সাইদুল ইসলাম সিকদার ওরফে সাকু ও আমাকে এবং আমার দুই ছেলে- ফামির সিকদার (১২) ও সানজু সিকদারকে (৯) জিম্মি করে রাখে। এরপর আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে যায়। তিনি আরো বলেন, আটকের আগে চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনে সে সময়ে কর্মরত একজন পুলিশ কর্মকর্তা আমার মোবাইল ফোন থেকে মুসার মোবাইলে ফোন করে কথা বলেন। এরপর আমাকে, আমার ভাসুর এবং দুই ছেলেকে গুম করার ভয় দেখিয়ে রাস্তা থেকে মুসা এবং আমার ভাসুর সাকুকেও পুলিশ আটক করে নিয়ে যায়। আটকের ৯ দিন পর পুলিশ ভাসুরকে আদালতে হাজির করলেও স্বামী মুসাকে হাজির করেনি। এমনকি তারা আমার স্বামীকে আটক করছে একথাও স্বীকার করছে না।’

সে সময় সংবাদ সম্মেলন করে মুসাকে পুলিশ আটক করে নিয়ে যায় বলে দাবি করেন পান্না আকতার। তবে সিএমপির পক্ষ থেকে তখন তা অস্বীকার করা হয়।

মিতু হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ইন্সপেক্টর সন্তোষ কুমার চাকমা যুগান্তরকে বলেন, ‘মুসা এ মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামি। তাকে পেলে আরও অনেক কিছুই স্পষ্ট হতো। তাই সে কোথায় আছে সে বিষয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। সে যাতে দেশ ত্যাগ করতে না পারে সেজন্য দেশের সব বিমানবন্দর ইমিগ্রেশনে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এর আগে সিএমপির পক্ষ থেকে মুসাকে গ্রেফতারে ৫ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল।’

অসমর্থিত একটি সূত্র মুসা নিখোঁজ হওয়ার পর থেকেই তাকে গুম করা হয়েছে বলে দাবি করে আসছিল। মিতু হত্যার প্রকৃত রহস্য যাতে প্রকাশ না পায় সে জন্যই বাবুল আকতারের নির্দেশে তার অনুসারী তৎকালীন কিছু পুলিশ কর্মকর্তা মুসাকে গুম করে থাকতে পারে বলে ওই সূত্র অভিযোগ করেছে।

মুসাকে ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করে তৎকালীন সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার বলেছিলেন- ‘আমরা যে তথ্য পেয়েছি তা হচ্ছে- মুসার নির্দেশে এবং তদারকিতে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। মুসা স্বপ্রণোদিত হয়ে অথবা কারো নির্দেশে মিতুকে খুন করেছে কিনা- এটা জানার জন্য মুসাকে গ্রেফতার করা খুবই জরুরি।’

২০১৬ সালের ৫ জুন চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড়ে বাবুল আকতারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় অজ্ঞাত ৩জনকে আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় হত্যা মামলা করেন বাবুল আকতার। ওই বছরের ২৫ জুন হত্যায় জড়িত সন্দেহভাজন অন্যতম আসামি আনোয়ার হোসেন ও ওয়াসিমকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরদিন ২৬ জুন তারা আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি প্রদান করেন। জবানবন্দিতে তারা বলেন, মিতুকে হত্যার ১৫ থেকে ১৬ দিন আগে কালামিয়া বাজারের একটি বাসায় হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এ অপারেশন সফলভাবে চালানো হলে ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা পাওয়া যাবে বলে সে জানায়। অপারেশন চালানোর সময় কে কোথায়, কী অবস্থায়, কী দায়িত্ব পালন করবে সেই স্পটও নির্ধারণ করে দেয় মুসা। মিতুকে খুনের ৫ থেকে ৬ দিন আগে আরেকবার হত্যাচেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু ওইদিন নবী ও ওয়াসিম ভয় পেয়ে যাওয়ায় তা ব্যর্থ হয়। এই হত্যা মিশনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল মুসার ওপরই। তার নির্দেশনা মতে টাকার বিনিময়ে মোট ৭জন এ হত্যাকাণ্ডে অংশ নিয়েছিল। তারা হলো- কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসা, ওয়াসিম, রাশেদ, নবী, কালু, শাহজাহান ও আনোয়ার। হত্যাকাণ্ডে অস্ত্র সরবরাহ করে ভোলা। হত্যায় অংশ নেওয়াদের মধ্যে সরাসরি অংশ নেয় মুসা, ওয়াসিম ও নবী। ব্যাকআপ ফোর্স হিসাবে ছিল আনোয়ার, রাশেদ, কালু ও শাহজাহান। মুসা মোটরসাইকেলের ধাক্কা দিয়ে মিতুকে ফেলে দেয়। ছুরি দিয়ে আক্রমণ করে নবী। গুলি চালায় ওয়াসিম ও মুসা।

২০২০ সালের জানুয়ারিতে আদালতের নির্দেশে মিতু হত্যা মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তদন্তে বাবুল আকতারের সম্পৃক্ততা বেরিয়ে আসে। ১২ মে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পিবিআই। এর আগে ১১ মে মিতু হত্যা মামলার বাদী বাবুল আকতারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চট্টগ্রাম পিবিআইতে ডাকা হয়। এরপর তাকে হেফাজতে নিয়ে পরদিন মিতুর বাবা মোশাররফ হোসেনের করা মামলায় গ্রেফতার দেখায় পিবিআই। শনিবার রাতে বাবুল আকতারকে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে ফেনি কারাগারে স্থানান্তর করা হয়।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার দেওয়ান মোহাম্মদ তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘কারাগারে বসে এ মামলার অন্য আসামিদের প্রভাবিত করার সুযোগ নেই। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই তাকে (বাবুল) ফেনী জেলা কারাগারে পাঠানো হয়েছে।’

Facebook
Twitter
LinkedIn
Telegram
WhatsApp
Email
Print