বৃহস্পতিবার, ১৭ই জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বৃহস্পতিবার, ১৭ই জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ বৃহস্পতিবার, ১৭ই জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২রা শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২১শে মহর্‌রম ১৪৪৭ হিজরি

চাঞ্চল্যকর মিতু হত্যাকাণ্ড : স্বামী বাবুল আক্তারই নাটের গুরু

প্রভাতী ডেস্ক : স্বামী বাবুল আকতারের পরিকল্পনাতেই ভাড়াটে খুনিদের হাতে প্রাণ গেছে স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুর। এক এনজিও কর্মীর সঙ্গে নিজের পরকীয়ার ঘটনা জেনে যাওয়ায় স্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা করেন সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আকতার। কর্মজীবনে নিজের বিশ্বস্ত একাধিক সোর্সের মাধ্যমে এ হত্যাকাণ্ড ঘটান তিনি।

এজন্য ভাড়াটে খুনিদের পরিশোধ করেছিলেন ৩ লাখ টাকা! দীর্ঘ পাঁচ বছর পর এসে ওই ঘটনায় নতুনভাবে হত্যা মামলা দায়ের করেন মিতুর বাবা। এতে প্রধান আসামি বাবুল আকতারকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আগের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলসহ নানা ঘটনার পরম্পরা বিশ্লেষণ করে মিতু হত্যায় বাবুল আকতারই নাটের গুরু ছিলেন বলে মনে করছে তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই। যদিও রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে বাবুল আকতার এ বিষয়ে রোববার(১৬ মে) পর্যন্ত মুখ খোলেননি। ভুল তথ্য দিয়ে তিনি তদন্ত সংস্থাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন।

পিবিআই বলছে, বাবুল আকতারের বিরুদ্ধে স্ত্রী হত্যার অভিযোগ প্রমাণের মতো যথেষ্ট তথ্য-উপাত্ত তাদের হাতে রয়েছে।

এদিকে মিতু খুন হওয়ার পর চট্টগ্রামে এসে হাসপাতালে মর্গে স্ত্রীর জন্য বাবুল আকতারের কান্না, শোকে মুহ্যমান হয়ে জানাজায় ঢলে পড়া, স্ত্রীকে হত্যার পর শ্বশুরের বাসায় ওঠাসহ সবকিছুই হত্যার দায় থেকে বাঁচাতে সাবেক এসপির সুনিপুণ অভিনয় ছিল বলে মনে করছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। রিমান্ডেও তিনি এমন অভিনয়ের আশ্রয় নিচ্ছেন।

তবে এত কিছুর পরও বাবুল আকতারের পার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে জানান তারা। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আজ সোমবার বাবুল আকতারকে আদালতে তোলা হবে। জিজ্ঞাসাবাদে নিজের সম্পৃক্ততা নিয়ে তিনি মুখ খোলেননি।

পিবিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার বলেছেন, ‘বাবুল আকতার জিজ্ঞাসাবাদকারী টিমকে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন। প্রয়োজনে তাকে আবারো রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী বাবুল আকতারের সন্তানের সঙ্গে কথা বলতে চান তারা। যে এনজিও কর্মীর সঙ্গে বাবুল আকতারের পরকীয়া ছিল বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ওই এনজিও কর্মী এবং তার গৃহকর্মীর সঙ্গে কথা বলবেন তারা। হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্বদানকারী মুসাকেও আইনের আওতায় আনতে তাদের টিম নতুন করে কাজ করছে।’

২০১৬ সালের ৫ জুন ভোরে ছেলেকে স্কুল বাসে তুলে দিতে যাওয়ার সময় চট্টগ্রাম নগরীর জিইসি মোড় এলাকায় মিতুকে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়। মিতুর স্বামী তৎকালীন এসপি বাবুল আকতার তখন ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। ঢাকা থেকে এসে তিনি নগরীর পাঁচলাইশ থানায় এ ঘটনায় অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় হত্যাকাণ্ডের জন্য তিনি জঙ্গিদের দায়ী করেছিলেন।

গত মঙ্গলবার এই মামলার বিষয়ে জানতে বাবুল আকতারকে হেফাজতে নেয় পিবিআই। গত বুধবার দুপুরে শ্বশুরের দায়ের করা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে বাবুল আকতারকে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সরোয়ার জাহানের আদালতে হাজির করে পিবিআই। ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন জানালে শুনানি শেষে আদালত পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। রিমান্ডের প্রতিবেদন ১০ দিনের মধ্যে আদালতে দাখিল করারও নির্দেশ দেওয়া হয়।

নতুন মামলায় বাবুল আকতারসহ ৮ আসামি : মিতুর বাবা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে বুধবার পাঁচলাইশ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় নিহত মিতুর স্বামী ও চাকরিচ্যুত পুলিশ সুপার বাবুল আকতারকে (৪৫)। অন্য আসামিরা হলেন : চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার মধ্যম ঘাগড়া এলাকার মৃত শাহ আলম সিকদারের ছেলে মো. কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসা (৪০), নগরীর বাকলিয়া থানার রাজাখালী এলাকার মৃত সিরাজুল হকের ছেলে এহতেশামুল হক ওরফে হানিফুল হক ওরফে ভোলাইয়া (৪১), রাঙ্গুনিয়া উপজেলার দক্ষিণ রাজানগর (গলাচিপা) এলাকার আব্দুল নবীর ছেলে মো. মোতালেব মিয়া ওরফে ওয়াসিম (২৭), ফটিকছড়ি উপজেলার রাঙ্গামাটিয়া পাইড্রালিকুল এলাকার সামছুল আলমের ছেলে আনোয়ার হোসেন (২৮), রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের মৃত মতিউর রহমানের ছেলে মো. খায়রুল ইসলাম ওরফে কালু (২৮), রাঙ্গুনিয়া উপজেলার মধ্যমঘাগড়া রানীহাট এলাকার মৃত শাহ আলম সিকদারের ছেলে মো. সাইদুল ইসলাম সিকদার ওরফে সাকু (৪৫) ও রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ঘাগড়াকুল রানীরহাট এলাকার মৃত কবির আহম্মদের ছেলে শাহজাহান মিয়া (২৮)। এদের মধ্যে গ্রেফতার আছেন বাবুল আকতারসহ ৫জন।

পালিয়ে থাকা তিন আসামি যাতে দেশ ত্যাগ করতে না-পারে, সেজন্য দেশের সব বিমানবন্দর ও সীমান্তে চিঠি দিয়েছে পিবিআই।

এ প্রসঙ্গে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, ‘আমরা আসামিদের গ্রেফতারে তৎপর আছি। এজাহারভুক্ত আট আসামির মধ্যে বাকি তিন আসামি যাতে দেশ ত্যাগ করতে না-পারে, সেজন্য গত বৃহস্পতিবার দেশের সব বিমানবন্দরে চিঠি পাঠানো হয়েছে।

মামলার এজাহারে যা আছে : নিহত মাহমুদা খানম মিতুর বাবা পাঁচলাইশ থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে উল্লেখ করেন, ২০১৬ সালের ৫ জুন সকাল সাড়ে ৬টায় মাহমুদা খানম মিতু তার ছেলে আকতার মাহমুদ মাহীরকে (৭) স্কুলবাসে তুলে দেওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে পাঁচলাইশ থানাধীন জিইসি মোড় যান। ওত পেতে থাকা তিন সন্ত্রাসী ছুরিকাঘাত ও গুলি করে মিতুকে হত্যা করে মোটরসাইকেল দিয়ে গোল পাহাড়ের দিকে পালিয়ে যায়।

এ ঘটনার একদিন পর মিতুর স্বামী সাবেক পুলিশ সুপার বাবুল আকতার বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা করেন। হত্যাকাণ্ডে জড়িত অপরাধীদের শনাক্ত করার লক্ষ্যে ঘটনাস্থল ও আশপাশে থাকা সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করা হয়। সংগৃহীত সিসিটিভির ফুটেজ সে সময় বাবুল আকতারকে দেখানো হয়। কিন্তু সে হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্বদানকারী মো. কামরুল ইসলাম সিকদার ওরফে মুসা তার দীর্ঘদিনের বিশ্বস্ত ও পারিবারিক পরিচিত সোর্স হওয়া সত্ত্বেও সুকৌশলে তাকে শনাক্ত না-করে জঙ্গিদের দ্বারা হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে দাবি করেন।

হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা করেন। ওই মামলাটি তদন্ত শেষে তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলার বাদী বাবুল আকতারসহ তদন্তে প্রায় সব বিবাদীগণ অত্র হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার বিষয়ে প্রমাণ পান।

এজাহারে আরো বলা হয়, বাবুল আকতার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসাবে কক্সবাজারে কর্মরত থাকা অবস্থায় একটি এনজিও সংস্থার ফিল্ড অফিসার গায়ত্রী অমর শিং নামে এক নারীর সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে পড়েন। এই সম্পর্কের জেরে মিতুর পরিবারে অশান্তি দেখা দেয়। পরকীয়া সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ব্যাপারে প্রতিবাদ করায় মিতুকে বিভিন্ন সময় শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করেন বাবুল আকতার।

২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত বিদেশে (সুদান) মিশনে কর্মরত থাকাকালীন তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বর চট্টগ্রামের বাসায় রেখে গেলে গায়ত্রী ওই মোবাইল নম্বরে বিভিন্ন সময়ে ২৯ বার বিভিন্ন মেসেজ দেন। এই মেসেজগুলো মিতু তার ব্যবহৃত একটি খাতায় নিজ হাতে লিখে রাখে। সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডের কয়েক মাস আগে বাবুল আকতার চীনে ট্রেনিংয়ে গেলে আমার মেয়ে (মিতু) গায়ত্রীর উপহার দেওয়া দুটি বই খুঁজে পায়। এর মধ্যে একটি বইয়ের শেষ পৃষ্ঠা ২৭৬-এর পরের পাতায় বাবুল আকতারের নিজের হাতে ইংরেজিতে গায়ত্রীর সাক্ষাতের কথা লেখা আছে।

উল্লিখিত ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে উভয়ের মধ্যে পারিবারিক অশান্তি চরমে পৌঁছে। বাবুল আকতারের এ ধরনের অনৈতিক কর্মকাণ্ডে মিতু প্রতিবাদ করলে তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে। মামলার এজাহারে পরকীয়ার জেরেই বাবুল আকতার পরিকল্পনা করেই তার মেয়েকে হত্যা করেছেন বলে বাদী দাবি করেন।

আজ আদালতে তোলা হবে : পাঁচ দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে আজ সোমবার আদালতে তোলা হবে বাবুল আকতারকে। তবে রিমান্ডে মিতু হত্যাকাণ্ড নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো তথ্য দেননি বাবুল আকতার। এ কারণে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ফের রিমান্ড চাওয়া হতে পারে বলে জানা গেছে।

বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন বাবুল আকতার : তদন্তকারী সংস্থার সূত্র বলছে, রিমান্ডে বিভ্রান্তিকর তথ্য দিচ্ছেন বাবুল আকতার। মিতুকে হত্যা সম্পর্কে দায় স্বীকার করা তো দূরে থাক, বাবুল আকতার নিজেকে নির্দোষ দাবি করছেন। এর আগে গ্রেফতার হওয়ার পর বাবুল আকতার পুলিশকে বাসার ঠিকানা নিয়েও বিভ্রান্তিকর তথ্য দেন। দিয়েছেন ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বাসার ভুল ঠিকানা। পরে বাবুল আকতারের গাড়িচালকের সহায়তায় সঠিক ঠিকানা পাওয়া যায়।

ওই গাড়িচালক বাবুল আকতারকে চট্টগ্রাম পিবিআই কার্যালয়ে নিয়ে এসেছিলেন। যদিও মোহাম্মদপুরের ওই বাসায় বাবুলের বর্তমান স্ত্রী ও সন্তানদের পাওয়া যায়নি। এদিকে পিবিআই কর্মকর্তারা জানান, বাবুল আকতারের সঠিক ঠিকানা এবং তার স্ত্রী-সন্তানরা কোথায় আছেন, তা জানতে বাবুল আকতারের স্বজনদের মেসেজ দেওয়া হয়েছে।

বাবুলের সন্তানদের জিম্মায় চাইবেন নানা : বাবুল আকতারের দুই শিশুসন্তান-ছেলে আকতার মাহমুদ মাহীর (১২) ও মেয়ে তাবাসসুম তাজনীন তাপুকে (৯) নিজের জিম্মায় রাখতে চাইছেন বাবুল আকতারের শ্বশুর মোশাররফ হোসেন। এজন্য তিনি আদালতের দ্বারস্থ হবেন বলেও রোববার সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, ছেলের সামনেই যেহেতু তার মাকে নির্দয়ভাবে খুন করা হয়েছে, সেহেতু বাবুল আকতার ও তার স্বজনদের কাছে আমার দুই নাতি-নাতনি নিরাপদ নয়। তাদের আমার জিম্মায় দেওয়ার জন্য আদালতের কাছে আবেদন জানাব। আদালত যদি আমার জিম্মায় দেয় তবে আমার নাতি-নাতনিদের আমার কাছে রেখেই মানুষ করব।’

পুরোনো মামলা থেকে অব্যাহতি পেল গুন্নু ও নাছের : মিতু হত্যার পর তদন্তে নেমে ঘটনায় জড়িত সন্দেহে বেশ ক’জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। এর মধ্যে আবু নাসের গুন্নু ও রবিন নামে দুই ব্যক্তিও ছিলেন। গত বুধবার মিতু হত্যায় বাবুল আকতারের দায়ের করা মামলায় আদালতে ফাইনাল রিপোর্ট দিয়েছে পিবিআই। মিতু হত্যা মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে আবু নাসের গুন্নু ও রবিনকে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সন্তোষ কুমার চাকমা বলেন, এর আগে গ্রেফতার হওয়া আবু নাসের গুন্নু ও রবিনের কোনো সম্পৃক্ততা এ মামলায় পাওয়া যায়নি। এ কারণে মামলা থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হয়েছে আদালতে।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Telegram
WhatsApp
Email
Print