Search

শুক্রবার, ২২শে আগস্ট ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শুক্রবার, ২২শে আগস্ট ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ শুক্রবার, ২২শে আগস্ট ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৭ই ভাদ্র ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২৭শে সফর ১৪৪৭ হিজরি

পদ্মার স্বপ্ন রূপ নিল বাস্তবে !

প্রভাতী ডেস্ক : ‘সাবাস বাংলাদেশ। এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়’- সত্যিই তাই। এ এক সাহসী স্বপ্নের দৃশ্যমান বাস্তবতা। এ এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, দীর্ঘ প্রতীক্ষীত একটি ক্ষণ, নানা বাধা বিপত্তি পেরিয়ে সংকল্পে অটুট থেকে ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছানোর গল্প। বেলা তখন ১২টা ২ মিনিট। পদ্মার বুকে বসানো হলো ৪১তম অর্থাৎ শেষ স্প্যানটি। সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ণ অবয়বে আত্মপ্রকাশ করল স্বপ্নের পদ্মা সেতু। প্রমত্তা পদ্মার দুই পারের এ সম্মিলনে চারপাশ মুখর হয়ে ওঠলো উল্লাসধ্বনিতে। বাঙালি মাথা নোয়াবার নয়- ঝিলিক দেওয়া রোদও যেন জানান দিতে চাইছে স্পর্ধিত এ বার্তা। এ মাহেন্দ্রক্ষণ ঘিরে পদ্মাপারে ছিল উৎসবের আমেজ। কেবল দুই তীরের বাসিন্দারাই নন, ঢাকা থেকেও অনেকে সেখানে উপস্থিত হন ঐতিহাসিক মুহূর্তটির সাক্ষী হয়ে থাকতে। সর্বশেষ বসানো স্প্যানটির এক পাশে টাঙানো হয় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা, অন্য পাশে প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী দেশ চীনের পতাকা।

৩২শ মেট্রিকটন ওজনের ১৫০ মিটার দীর্ঘ ৪১তম স্প্যানটি মাওয়ার কুমারভোগের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড থেকে নিয়ে ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটির কাছে পৌঁছে যায় ভাসমান ক্রেন ‘তিয়ান ই’। বৃহস্পতিবার (১০ই ডিসেম্বর)

সকাল ৯টায় যখন পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যান বসানোর কাজ শুরু হয় তখন চারপাশ কুয়াশায় মোড়ানো। একদিকে ইঞ্চি মেপে মেপে ৪১তম স্প্যানটি বসানোর কাজ এগুতে থাকে। অন্যদিকে আকাশের মলিন মুখও ধীরে ধীরে ফর্সা হতে থাকে। বেলা ১২টা ২ মিনিটে ১২ ও ১৩ নম্বর খুঁটিতে শেষ স্প্যানটি বসানোর মাধ্যমে যুক্ত হয় প্রমত্তা পদ্মার দুই পার। একপ্রান্তে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া, অন্যপ্রান্তে শরীয়তপুরের জাজিরা। পদ্মার বুকে পুরো অবয়ব নিয়ে দেখা দেয় স্বপ্নের সেতু।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বের কারণেই স্বপ্নের পদ্মা সেতু দৃশ্যমান হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। গতকাল তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মানবিক ও সাহসী নেতৃত্বের কারণেই সব অসম্ভবকে সম্ভব করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে আমরাও পারি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মূল সেতুর নির্মাণ ও নদীশাসন কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। ২০১৭ সালে পদ্মা সেতুর প্রথম স্প্যান বসানোর সময় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। এবার শেষ স্প্যান বসানোর ঐতিহাসিক মুহূর্তটি উদযাপনে বড় কর্মসূচি নেওয়া হয়নি করোনা পরিস্থিতির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে।

৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ সেতুটির শেষ স্প্যানটি বসানোর কাজ দেখতে কৌতুহলী অনেকে নৌকা, ট্রলার, স্পিডবোট ভাড়া করে নদীর বুকে ভিড় জমায়। সর্বশেষ স্প্যানটি বসানোর মাধ্যমে কাঙ্খিত পদ্মা সেতুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় কাজের সমাপ্তি হলো। এরপর সড়ক ও রেলের স্ল্যাব বসানো সম্পন্ন হলে সেতু দিয়ে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল করতে পারবে। এতে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২৯ জেলার সঙ্গে সারাদেশের সরাসরি সংযোগ স্থাপন হওয়ার পথ উন্মুক্ত হবে।

২০২১ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই সেতুটি যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। যদিও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, ২০২২ সালের মধ্যে পুরোপুরি চালু হবে সেতুটি।

স্টিল ও কংক্রিটের মিশ্রণে হচ্ছে দেশের অন্যতম এ অবকাঠামোটির নির্মাণকাজ। সেতুর মূল কাঠামো বা স্প্যানগুলো স্টিলের এবং খুঁটি ও যান চলাচলের পথটি কংক্রিটের। প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার। ৪২টি খুঁটির সঙ্গে ৪১টি স্প্যান যুক্ত করার মাধ্যমে পুরো সেতু দৃশ্যমান হয়েছে। প্রথম স্প্যানটি বসেছিল ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর। আর সবগুলো স্প্যান বসাতে লেগেছে ৩ বছর ২ মাস। যে ৪১টি স্প্যান দিয়ে পুরো পদ্মা সেতু তৈরি হচ্ছে, তার মধ্যে জাজিরা প্রান্তে ২০টি বসানো হয়েছে। মাওয়া প্রান্তে বসানো হয় ২০টি। একটি স্প্যান বসেছে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের মাঝখানে।

সেতু বাস্তবায়নে পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর পথ :

পদ্মা সেতুর জন্য অপেক্ষা প্রায় দুই যুগের। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে ১৯৯৮ সালে প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই দিয়ে এই অপেক্ষার শুরু। এর মাঝখানে অর্থায়ন নিয়ে বিশ্বব্যাংকসহ দাতাদের সঙ্গে জটিলতায় স্বপ্নের সেতুর ভবিষ্যৎই শঙ্কায় পড়ে যায়। এর মধ্যে সরকার বিশ্বব্যাংকের ঋণ না নিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়। তবে পথটি মোটেও মসৃণ ছিল না। নকশা জটিলতার কারণে এক বছর পিছিয়ে যায়। ২২টি খুঁটির নিচে নরম মাটি পাওয়া যায়। শুরুতে প্রতিটি খুঁটির নিচে ছয়টি করে পাইল (মাটির গভীরে স্টিলের ভিত্তি) বসানোর পরিকল্পনা ছিল। যুক্তরাজ্যের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নকশা সংশোধন করে একটি করে পাইল বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত দেয়। এজন্য খুঁটি নির্মাণকাজ পুরোপুরি শেষ হতে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত লেগে যায়। সব মিলিয়ে এই কাজে প্রায় এক বছর বাড়তি লাগে। এজন্য মাঝখানে কাজের কিছুটা গতি হারায়। ঠিকাদারকে ২ বছর ৮ মাস বাড়তি সময় দেওয়া হয়।

মূল সেতু ও নদীশাসনের কাজ শুরুর পর নানা চ্যালেঞ্জ এসেছে। কখনো পদ্মার ভাঙন, আবার কখনো কারিগরি জটিলতায় কাজ আটকে গেছে। ফেরিঘাট স্থানান্তরেও সময়ক্ষেপণ হয়; কিন্তু কাজ থেমে থাকেনি। তাছাড়া করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি এবং বন্যার অত্যাধিক স্রোত পদ্মা সেতুর কাজে কিছুটা গতি কমিয়ে দিয়েছিল। করোনা ও বন্যা পরিস্থিতি কাটিয়ে গত ১১ই অক্টোবর ৩২তম স্প্যান বসানোর পর অনুকূল আবহাওয়া পাওয়া যায়। কারিগরি কোনো জটিলতা তৈরি হয়নি। ফলে বাকি স্প্যানগুলো টানা বসানো সম্ভব হয়।

২০০১ সালের ৪ঠা জুলাই পদ্মা সেতুর নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিস্তারিত সমীক্ষার পর ২০০৪ সালে মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয় জাপানের দাতা সংস্থা জাইকা। ২০০৭ সালে একনেকে পাস হওয়া পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। ২০১১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। এর পর প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন না করে ২০১৮ সালের জুনে আবার ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।

যেসব কাজ বাকি :

সবগুলো স্প্যান বসানো শেষ হওয়ার পর এখন মোটা দাগে সড়ক সংযোগের পাশাপাশি বাকি রইল ১৬৩২টি রোডওয়ে স্ল্যাব ও ১০২৯টি রেলওয়ে স্ল্যাব স্থাপন, ব্রিজের রেলিং, স্ট্রিট ও আর্কিটেকচার লাইটিং স্থাপন এবং গ্যাস ও বিদ্যুৎ লাইন যুক্ত করা।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Telegram
WhatsApp
Email
Print