
প্রভাতী ডেস্ক: সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবিতে সারাদেশে গণ-অবস্থান কর্মসূচিতে যুগপৎ আন্দোলনে মাঠে নেমেছে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো। গণ-অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বুধবার(১১ জানুয়ারি) সকাল থেকেই নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জড়ো হন দলটির নেতাকর্মীরা। চার ঘণ্টার গণ-অবস্থান কর্মসূচিতে সমমনা রাজনৈতিক জোটগুলোও নিজ নিজ অবস্থান থেকে অংশ নেন।
গণ-অবস্থান থেকে বিএনপি মহাসচিব ১০ দফা দাবি বাস্তবায়ন এবং বিদ্যুতের মূল্য কমানোর দাবিতে আগামী ১৬ জানুয়ারি সারাদেশের জেলা, মহানগর, উপজেলা ও পৌর এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশের ঘোষণা দেন।
গণ-অবস্থান কর্মসূচিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘নির্যাতন, নিপীড়ন, অত্যাচার ছাড়া এরা (আ.লীগ) আর ক্ষমতায় টিকতে পারবে না। আজ সব রাজনৈতিক দল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য, ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়ার জন্য এক হয়েছে। ১০ দফা বাস্তবায়নসহ একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে পুরো জাতি আজ ঐক্যবদ্ধ। আজকে জনগণ জেগে উঠেছে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা জেগে উঠেছেন। গণমাধ্যমও গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য ভূমিকা রাখছে।’
ফখরুল বলেন, ‘গত ৭ ডিসেম্বর বিএনপি অফিসে পুলিশ ডাকাতের মতো হামলা করে আমাদের শতশত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। লুটপাট চালিয়েছে পার্টি অফিসে। এগুলো করেছে আমাদের ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ বানচাল করার জন্য। কিন্তু সরকারের কূটকৌশল বাস্তবায়ন হয়নি। ঢাকাসহ সারাদেশের মানুষ সব বাধা উপেক্ষা করে গণসমাবেশ সফল করে সরকারের অন্যায়ের জবাব দিয়েছে।’
বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘সাধারণ মানুষ আজ বলছে তারা আর পারছে না। চাল কিনতে পারে না, খাদ্য কিনতে পারে না। ওয়াসার এমডি আমেরিকায় ১৪টি বাড়ি কিনেছে। তিনি হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। আজকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। তারা সব ব্যাংক লুট করে ফোকলা করে দিয়েছে। সরকারের লুটের রাজ্য গড়ে তুলেছে।’
মির্জা ফখরুল বলেন, ‘অবিলম্বে সংসদ ভেঙে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। আওয়ামী লীগ পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। বিচার বিভাগসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি অবকাঠামো আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এ থেকে দেশকে রক্ষা করতে কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে এ জালিম শাহী সরকারের পতন ঘটাতে হবে।’
গণ-অবস্থান কর্মসূচিতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আমরা কাউকে ধাক্কা দিয়ে, টোকা দিয়ে ক্ষমতা থেকে ফেলতে চাই না। সঠিক স্বচ্ছ নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা এই সরকারের পতন ঘটাতে চাই। শান্তিপূর্ণ মিটিং-মিছিল করে সরকারের পতন ঘটাতে চাই। বিএনপি কোনো উচ্ছৃঙ্খল বিশৃঙ্খলায় বিশ্বাস করে না।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপির কোনো নেতাকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। সরকারের একজন বিএনপির নেতাদের কটাক্ষ করেছেন, আমি তাকে বলতে চাই- আপনি রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। বিএনপির কোনো নেতা ছোট নন। বিএনপির এই নেতাকর্মীরাই সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করবে।’
সাবেক এই মন্ত্রী বলেন, ‘উস্কানি দেবেন না, উস্কানি দিলে তার ফল ভালো হবে না। সাবধান হয়ে যান। ১০ দফা দাবি মেনে নেন। নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জয়ী হলে ক্ষমতায় আসবেন। জোর করে ক্ষমতায় থাকার দিন শেষ। জোর করে আর ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না।’
তিনি বলেন, ‘১০ ডিসেম্বর আমাদের সমাবেশে আগের রাতে ৯ ডিসেম্বর আমাকে ও দলের মহাসচিবকে মধ্যরাতে গ্রেপ্তার করা হয়। আমাদেরকে ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়ার পর তারা এতোটাই ভীত-সন্ত্রস্ত ছিল যে আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, স্যার আপনারা কি সমাবেশ থেকে বসে পড়বেন?’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সভাপতিত্বে ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক ও দক্ষিণের সদস্য সচিব রফিকুল আলম মজনুর পরিচালনায় গণ-অবস্থান কর্মসূচিতে আরো বক্তব্য দেন- ভাইস-চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান, এজেডএম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান, আফরোজা খান রিতা, সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুস সালাম আজাদ, স্বেচ্ছাসেবক সম্পাদক মীর সরাফত আলী সপু, সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু, মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হেলেন জেরিন খান, যুবদলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মামুন হাসান, সাধারণ সম্পাদক মোনায়েম মুন্না, স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান, কৃষক দলের সভাপতি হাসান জাফির তুহিন, সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল, ছাত্রদলের সভাপতি কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ, সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েল, মহানগর দক্ষিণ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহবায়ক নবী উল্লাহ নবী, যুগ্ম আহ্বায়ক লিটন মাহমুদ প্রমুখ।
রাজধানীর পূর্ব পান্তে এলডিপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি আয়োজিত গণ-অবস্থান কর্মসূচিতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দলটির মহাসচিব ও সাবেক মন্ত্রী ড. রেদোয়ান আহমদ বলেন, ‘সমগ্র দেশের অবস্থা ছাত্রলীগের মঞ্চের মতো। যে-কোনো সময় ভেঙে পড়বে। এ মুহূর্তে দেশকে বাঁচাতে আমাদের দাবি একটাই, এ সরকারের পদত্যাগ। কারণ এ সরকারকে মানুষ আর ক্ষমতায় দেখতে চায় না। তারা আমাদের স্বাধীনতার সব আশা-আকাঙক্ষাকে গলা টিপে হত্যা করেছে। আমাদের হাতে আর সময় নেই, সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দাবি আদায়ে রাজপথেই ফয়সালা হবে।’
যুগপৎ আন্দোলনে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। গণতন্ত্র মঞ্চে জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনসহ গণসংহতি আন্দোলন- এই অবস্থান কর্মসূচিতে যোগ দেয়। কর্মসূচিতে সভাপতিত্ব করছেন অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম এবং সঞ্চালনা করেন ইমরান ইমন।
সরকারের পদত্যাগ, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ রাজবন্দিদের মুক্তি দাবিতে রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাংকের পেছনে গণ-অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন ১২ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা। জোটের সমন্বয়ক ও জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দারের সভাপতিত্বে ও জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদার পরিচালনায় গণ-অবস্থান কর্মসূচিতে বক্তব্য দেন- জোটভুক্ত বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীরা। ১২ দলের এই গণ-অবস্থানে উপস্থিত রয়েছেন- বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম, এনডিপির ক্বারী আবু তাহের, বাংলাদেশ এলডিপির শাহাদাত হোসেন সেলিম, জাতীয় পার্টির আহসান হাবিব লিংকন, ইসলামী ঐক্যজোটের অধ্যাপক আবদুল করিম, জাগপার অধ্যাপক ইকবাল হোসেন, লেবার পার্টির মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের মুহিউদ্দীন ইকরাম প্রমুখ।
এদিকে সরকারের পদত্যাগ, সংসদ বিলুপ্তসহ ১০ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনের অংশ হিসেবে দ্বিতীয় ধাপের কর্মসূচি পালন করেছে গণতান্ত্রিক জোট। গতকাল ঢাকাসহ ১০টি বিভাগীয় শহরে বেলা ১১টা থেকে দুইটা পর্যন্ত এই কর্মসূচি পালন করেন তারা। এ সময় প্ল্যাকার্ড ও ব্যানার নিয়ে জোটের নেতাকর্মীরা গণ-অবস্থানে অংশ নেন।
জোটের সমন্বয়ক মুহাম্মদ সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে এই গণ-অবস্থান কর্মসূচি উপস্থিত ছিলেন- ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের সভাপতি আজিজুল হাই সোহাগ, সাধারণ সম্পাদক মাহামুদুল করিম খানসহ জোটের শরিক বিভিন্ন সংগঠনের শীর্ষ নেতারা। এই জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদের সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন- জাগপার খন্দকার লুৎফর রহমান, এসএম শাহাদাত, ডিএলের সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি, ন্যাপ-ভাসানীর অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলাম, এনপিপির মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা, ফরিদ উদ্দিন, বিকল্পধারা বাংলাদেশের অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী, শাহ আহমেদ বাদল, গণদলের এ টি এম গোলাম মাওলা চৌধুরী, সাম্যবাদী দলের কমরেড নুরুল ইসলাম, বাংলাদেশ ন্যাপের এম এন শাওন সাদেকী ও ইঞ্জিনিয়ার আবদুল বারিকসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবিতে রাজধানীতে বিএনপির গণ-অবস্থানে সংহতি জানিয়ে অংশগ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ইউট্যাব)। রাজধানীর নয়াপল্টনে হোটেল ভিক্টোরির সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বিএনপি আয়োজিত গণ-অবস্থান কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করে অংশগ্রহণ করেন ইউট্যাবের নেতারা। ইউট্যাবের মহাসচিব অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানের নেতৃত্বে এসময় অধ্যাপক ড. লুৎফর রহমান, অধ্যাপক ড. আব্দুর রশিদ, অধ্যাপক ড. শামসুল আলম সেলিম, অধ্যাপক ড. কামরুল আহসান, অধ্যাপক ড. নুরুল ইসলাম, অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম, অধ্যাপক গোলাম রব্বানী, অধ্যাপক অধ্যাপক ড. আবুল হাসনাত মোহাম্মদ শামীম, অধ্যাপক খান মো. মনোয়ারুল ইসলাম শিমুল, অধ্যাপক আনিসুর রহমান, আবু জাফর, অধ্যাপক ড. আতাউর রহমান, অধ্যাপক এমরান, ড. শারমিন, অধ্যাপক ড. রইস উদ্দিন, অধ্যাপক শহিদউজ্জামানসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন।
বিএনপি ঘোষিত গণ-অবস্থান কর্মসূচিতে সংহতি জানিয়ে গণফোরামের একাংশের সভাপতি মোস্তফা মহসিন মন্টু বলেন, ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনার লড়াই শুরু হয়েছে। ভোটাধিকার পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত এই লড়াই চলবে।’ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ ‘মিথ্যা’ মামলায় গ্রেপ্তার এবং কারাবন্দি নেতাদের অবিলম্বে মুক্তির দাবি জানান মন্টু।