সোমবার, ১৪ই জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

সোমবার, ১৪ই জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ সোমবার, ১৪ই জুলাই ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ৩০শে আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৮ই মহর্‌রম ১৪৪৭ হিজরি

পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে ক্ষোভ: অস্বস্তি আওয়ামী লীগে

প্রভাতী ডেস্ক : পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের বক্তব্য নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় চলছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতারা। কর্মীরাও রীতিমতো বিস্মিত, হতবাক।

এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভারতকে অনুরোধ করার দায়িত্ব কাউকে দেওয়া হয়নি।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভারতের আনুকূল্যে সরকার টিকে আছে কিনা, তা জানতে চেয়েছেন।

গত বৃহস্পতিবার(১৮ আগষ্ট) চট্টগ্রামের জে এম সেন হলে জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমি ভারতে গিয়ে বলেছি- শেখ হাসিনাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, আমি ভারত সরকারকে সেটা করার অনুরোধ করেছি।” এসময় তিনি আরো বলেন, ভারতের সাথে অনেক ধরনের চুক্তি হয়, এসব কি এখানে বলি? না, বলিনা। তাঁর এই অসংলগ্ন বক্তব্য সঙ্গে সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে অবহিত করা হয়েছিল বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন মন্ত্রিসভা ও আওয়ামী লীগ সভাপতিমণ্ডলীর কয়েকজন সদস্য। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ওই বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী অসন্তোষও প্রকাশ করেছেন।

আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতা বলেছেন, চট্টগ্রামের ওই অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি বক্তব্য দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। আর প্রধানমন্ত্রীর ভার্চুয়াল বক্তৃতার পর সাধারণত কোনো অনুষ্ঠানে কেউ বক্তৃতা দেন না। কিন্তু চট্টগ্রামের অনুষ্ঠানে এর ব্যত্যয় ঘটেছে। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার পর অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শ ম রেজাউল করিমকে বক্তৃতা দেওয়ার অনুরোধ করা হলে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, প্রচলিত শিষ্টাচার অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতার পর কোনো মন্ত্রীর বক্তৃতা দেওয়াটা শোভনীয় নয়। এরপর তিনি অনুষ্ঠানস্থল থেকে চলে যান। কিন্তু অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ওই শিষ্টাচার না মেনে বিতর্কিত বক্তৃতা দেন।

এখন তাঁর সেই বক্তব্য নিয়ে তোলপাড়। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ভাষায়, জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের স্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করে আসা এ কে আব্দুল মোমেন ক্রমেই বিপজ্জনক হয়ে উঠছেন। তিনি তাঁর বড় ভাই প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সহায়তা নিয়ে সিলেট-১ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এমপি হন। পরবর্তী সময়ে হঠাৎ করেই স্পর্শকাতর দায়িত্বে ও গুরুত্বপূর্ণ পদে তথা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছেন। এর পর থেকে তিনি মুখে যা আসছে, তা-ই বলছেন। নানাভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করেছেন। আপত্তিকর ও বিস্ম্ফোরক মন্তব্য করে আলোচিত ও সমালোচিত হয়েছেন। বিরক্তির কারণও হয়েছেন।

তাঁকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিজনিত বর্তমান সংকটের মধ্যে তিনি কয়েক দিন আগে “দেশের মানুষ বেহেশতে আছে বলে” ব্যাপক সমালোচিত হন। আর এ জন্য তিনি গণমাধ্যমের ওপর দোষ চাপিয়েছেন। এর আগে তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ককে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করে তুমুল সমালোচনার জন্ম দেন। এবারও তিনি গণমাধ্যমের ওপর দোষ চাপিয়েছেন।

গতকাল শুক্রবার গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানের পর তিনি বলেছেন, দেশে সবার বাকস্বাধীনতা আছে। তাই সবাই সব কথা বলতে পারেন। তবে বক্তব্য অন্যভাবে উপস্থাপন করলে দুঃখ লাগে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা বলেছেন, আগামী সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে যাওয়ার কথা। এর আগে ভারতকে জড়িয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিব্রতকর মন্তব্য নতুন করে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তাই তিনি কেন এমন অসংলগ্ন বক্তব্য দিলেন, এর কারণ খোঁজার চেষ্টা হচ্ছে। এটা শিশুসুলভ বালখিল্য, অসুস্থতা, কারও ইশারা-ইঙ্গিত, আলোচনায় থাকা, নাকি ইচ্ছে করে সরকারকে বিপাকে ফেলা- সব কিছুই নিবিড়ভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যকে প্রধানমন্ত্রীর জন্য বিব্রতকর হিসেবেও দেখছেন কেউ কেউ। তাঁরা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অতিকথন, রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি ও আত্মসম্মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

ভারতও লজ্জা পাবে: ওবায়দুল কাদের

শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে ভারতকে অনুরোধ করা সংক্রান্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের কঠোর সমালোচনা করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘যিনি এ কথা বলেছেন, সেটি তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত হতে পারে। এটি আমাদের সরকারেরও বক্তব্য নয়, দলেরও বক্তব্য নয়। এই বক্তব্যের কারণে ভারতও লজ্জা পাবে।’

গতকাল শুক্রবার রাজধানীর পলাশীর মোড়ে ঐতিহাসিক জন্মাষ্টমীর শোভাযাত্রা উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ বন্ধুত্বের সম্পর্কে আবদ্ধ। ভারত বাংলাদেশের দুঃসময়ের বন্ধু। কিন্তু তাই বলে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ভারতকে অনুরোধ করব! এই ধরনের অনুরোধ আওয়ামী লীগ করে না, কখনও করেনি। শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষ থেকে কাউকে বলার দায়িত্বও দেওয়া হয়নি।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অহেতুক কথা না বলার পরামর্শ দিয়ে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘কীভাবে আমরা এই কথা বলি! বন্ধু বন্ধুর জায়গায় আছে। অহেতুক কথা বলে এটি নষ্ট করবেন না।’ তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সব ক্ষমতার উৎস বাংলাদেশের জনগণ। বাইরের কেউ ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পারবে না। আল্লাহর ইচ্ছা এবং জনগণের সমর্থনে আওয়ামী লীগ টিকে আছে। ভবিষ্যতেও টিকে থাকবে ইনশাআল্লাহ।

বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে ওবায়দুল কাদের বলেন, বাংলাদেশ-ভারতের শান্তিপূর্ণভাবে ছিটমহল বিনিময় দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেটি করেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে থাকা সমস্যা নিয়ে আলোচনা চলছে। আগামী সেপ্টেম্বরে বঙ্গবন্ধুকন্যার ভারতে যাওয়ার কথা। তখন হয়তো আরও কিছু বিষয়ে মতৈক্য হবে। লেনদেন, পার্টনারশিপ আরও জোরদার করার জন্য আলাপ-আলোচনা হবে।

তিনি বলেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ কোনো বিরোধ, কোনো বৈরিতার সম্পর্ক চায় না। পঁচাত্তরের পর ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক করে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর সেই অবিশ্বাসের সম্পর্ক ও সংশয়ের দেয়াল ভেঙে দিয়েছেন।

সরকার টিকে আছে ভারতের আনুকূল্যে- মির্জা ফখরুল

ভারতের ‘আনুকূল্যে’ সরকার টিকে আছে কিনা- প্রশ্ন রেখে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের ব্যাখ্যা দাবি করেছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ‘আমরা এই সরকারের কাছে, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে এবং ভারত সরকারের কাছেও জানতে চাই, পররাষ্ট্রমন্ত্রী যে কথা বলেছেন, সেই কথার অর্থ কী? তাতে কী এটি দাঁড়ায়, এই সরকার টিকে আছে ভারতের আনুকূল্যে? এ কথার অর্থ মানুষ তো জানতেই চাইবে। এটা জরুরি কথা।’

গতকাল শুক্রবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে বিএনপি মহাসচিব আরও বলেন, ‘গত বুধবার ঢাকায় আওয়ামী লীগের মিছিল-সমাবেশে মন্ত্রীরা হুমকি দিয়েছেন, হুঙ্কার দিয়েছেন। সন্ত্রাসী ভাষায় কথাবার্তা বলেছেন। এতই যদি আপনারা হুমকি-ধমকি দেন, তাহলে আবার আপনাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য, প্রধানমন্ত্রীকে টিকিয়ে রাখার জন্য ভারতের সাহায্য দাবি করেন কেন?’

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আজকে প্রশ্ন উঠেছে- বাংলাদেশ কি সত্যিকার অর্থে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র থাকবে কি থাকবে না, বাংলাদেশ কি সত্যিকার অর্থেই একটা গণতান্ত্রিক দেশ থাকবে কি থাকবে না, বাংলাদেশ কি সত্যিকার অর্থে মানুষের অধিকারগুলো ফিরিয়ে একটা সমৃদ্ধ বাংলাদেশ তৈরি করবে কি করবে না।

Facebook
Twitter
LinkedIn
Telegram
WhatsApp
Email
Print