
পিরিয়ড মেয়েদের জীবনের স্বাভাবিক এক প্রক্রিয়া, কিন্তু সব অভিভাবকই এই বিষয়ে সন্তানদের সঙ্গে স্বাচ্ছন্দ্যে কথা বলতে পারেন না। ফলে প্রথমবার মাসিক হলে অনেক মেয়ে ভয়, বিভ্রান্তি বা উদ্বেগে পড়ে।তারা বুঝতে পারে না কী হচ্ছে, কী করা উচিত। অথচ তাদের জানানো দরকার—মাসিক একদম স্বাভাবিক এবং এই সময় তারা মা-বাবা বা অন্যান্য বিশ্বাসযোগ্য প্রাপ্তবয়স্কদের কাছ থেকে সহায়তা পেতে পারে।
এ কারণেই জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা - ইউনিসেফ বাড়িতে আপনার মেয়ে শিশুকে পিরিয়ড বিষয়ে সচেতন করার জন্য কিছু নির্দেশনা দিয়েছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক-
কেন মাসিক নিয়ে কথা বলা জরুরি
মাসিক নিয়ে কথা বললে সন্তান নিজের শরীর সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা পায় এবং নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে শেখে। এতে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনগুলো বোঝা সহজ হয়, ভয় বা লজ্জা দূর হয় এবং সন্তানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও গভীর হয়।
কথার শুরু করবেন কীভাবে
প্রথমে জিজ্ঞেস করুন, সে মাসিক সম্পর্কে কিছু জানে কি না বা বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু শুনেছে কি না। ভুল ধারণা থাকলে সেগুলো ঠিক করে দিন।
স্পষ্ট ভাষায় বলুন
মাসিক বোঝানোর সময় জটিল শব্দ না ব্যবহার করে পরিষ্কারভাবে বলুন—
‘যখন মেয়েরা বড় হতে থাকে, তখন শরীর সন্তান ধারণের উপযোগী হতে শুরু করে। প্রতি মাসে ডিম্বাশয় থেকে কিছু হরমোন নিঃসৃত হয়, যা জরায়ুর ভেতরের আবরণকে পুরু করে। যদি কোনো ডিম্বাণু নিষিক্ত না হয়, তখন সেই আবরণ ভেঙে যায় এবং যোনিপথ দিয়ে রক্ত ও অন্যান্য উপাদান বের হয়। এটাকেই পিরিয়ড বা মাসিক বলে।”
এটি স্বাভাবিক বিষয় — বুঝিয়ে বলুন
মেয়েকে আশ্বস্ত করুন, পিরিয়ড কিশোর বয়সে শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা সাধারণত ৮ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে শুরু হয়।
অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলুন
পিরিয়ড শুরুর আগে অনেক পরিবর্তন ঘটে — বক্ষ ও শরীরের লোম বৃদ্ধি, নিতম্বের আকৃতি বদল, মেজাজের ওঠানামা ইত্যাদি। এগুলো ভয়ের কিছু নয়। ব্যায়াম, গভীর শ্বাস নেওয়া বা হালকা স্ট্রেচিং মুড ভালো রাখতে সাহায্য করে।
মাসিকের সময় পেটব্যথা হতে পারে, তবে তা ব্যক্তিভেদে আলাদা। হালকা হাঁটা, পর্যাপ্ত ঘুম, প্রচুর পানি পান ও প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ খেলে আরাম পাওয়া যায়।
সক্রিয় থাকা ও পুষ্টিকর খাবার
মাসিকের সময় সব কাজ আগের মতোই করা যায়। নিয়মিত ব্যায়াম ও সুষম খাদ্য শরীর ও মন দুটোকেই ভালো রাখে। লোহা ও ফলিক অ্যাসিডসমৃদ্ধ খাবার খাওয়া জরুরি, কারণ এদের ঘাটতি ক্লান্তি, মনোযোগে সমস্যা ও অবসাদ তৈরি করতে পারে।
স্যানিটারি পণ্য পরিচিত করানো
কন্যাকে বুঝিয়ে বলুন - ডিসপোজেবল প্যাড, পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্যাড, ট্যাম্পন, কাপড়, মেন্সট্রুয়াল কাপ, ডিস্ক বা পিরিয়ড আন্ডারওয়্যার — সবই নিরাপদ। কোনটি ব্যবহার করবে তা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত পছন্দ।
তবে মেয়েকে বুঝিয়ে দিন কীভাবে নিরাপদভাবে এগুলো ব্যবহার করতে হয়। ট্যাম্পন বা মেন্সট্রুয়াল কাপ যোনিতে ঢোকাতে হয়, তাই প্রথমে একটু সহায়তা লাগতে পারে।
সময়মতো স্যানিটারি পণ্য পরিবর্তন করতে হবে — যেমন ট্যাম্পন প্রতি ৪–৮ ঘণ্টায়, প্যাড প্রতি ৬ ঘণ্টায়। পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্যাড বা কাপড় ব্যবহার করলে স্কুলে সেগুলো আলাদা ব্যাগে বাড়ি নিয়ে ধোয়ার বিষয়টিও বুঝিয়ে বলুন।
স্কুল ব্যাগে কিছু অতিরিক্ত প্যাড রাখা ভালো, যাতে হঠাৎ মাসিক শুরু হলে প্রস্তুত থাকা যায়।
সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দিন
১. কখন মাসিক শুরু হবে?
সাধারণত স্তন বৃদ্ধি শুরুর দুই বছর পর মাসিক হয়। আন্ডারআর্ম বা যৌনাঙ্গের লোম উঠলে বুঝতে হবে মাসিক আসন্ন।
২. কতদিন স্থায়ী হবে?
প্রথম দিকে অনিয়মিত হতে পারে, পরে সাধারণত ২৩–৩৮ দিনের ব্যবধানে হয় এবং ২–৮ দিন স্থায়ী থাকে।
৩. রক্তপাত কেমন হবে?
শুরুতে হালকা গোলাপি বা পাতলা লাল রঙের, পরে বাদামি বা ঘন হতে পারে।
৪. রক্ত কতটা হবে?
প্রথম দিকে কম হয়, পরে সাধারণত ১–৫ টেবিল চামচ পরিমাণ।
কখন থেকে কথাবার্তা শুরু করবেন
অধিকাংশ মেয়ের প্রথম মাসিক হয় ১২ বছর বয়সে, কিন্তু ৮ বছর বয়স থেকেও শুরু হতে পারে। তাই আগেভাগে খোলামেলা আলোচনা শুরু করা উচিত।
বিষয়টি হঠাৎ তুলবেন না—প্রয়োজনে শরীরের পরিবর্তন, বাচ্চা কোথা থেকে আসে, বা স্যানিটারি পণ্য কেনার সময় সহজভাবে প্রসঙ্গ তুলুন।
স্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতা অভ্যাস
মাসিক চলাকালীন সঠিক স্বাস্থ্যবিধি সংক্রমণ, দুর্গন্ধ ও অস্বস্তি রোধে সাহায্য করে। মেয়েকে বোঝান—
প্রতিদিন পরিষ্কার পানি দিয়ে বাইরের যৌনাঙ্গ ধুতে হবে।
সাবান নয়, কেবল পানি ব্যবহার করাই যথেষ্ট; যোনি নিজে থেকেই পরিষ্কার হয়।
টয়লেট ব্যবহারের পর বা প্যাড পরিবর্তনের আগে ও পরে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে।
ব্যবহৃত প্যাড বাথরুমে না ফেলে ডাস্টবিনে ফেলতে হবে।
হালকা, বাতাস চলাচল করে এমন পোশাক পরা ভালো।
পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে।
মাসিকের সময়কাল ক্যালেন্ডারে বা মোবাইল অ্যাপে নোট করে রাখা উপকারী।
কখন ডাক্তারের পরামর্শ দরকার
যদি মেয়ের ব্যথা এত বেশি হয় যে হাঁটতে না পারে, অস্বাভাবিক রক্তপাত হয়, দীর্ঘদিন রক্ত বন্ধ থাকে বা দুই মাসিকের মাঝে রক্তপাত হয় — তাহলে চিকিৎসকের কাছে নিতে হবে।
১৬ বছর বয়স পর্যন্ত মাসিক না হলে বা অতিরিক্ত ব্যায়াম, অপুষ্টি বা মানসিক চাপে মাসিক বন্ধ থাকলে ডাক্তার দেখানো জরুরি।
অন্যদের সঙ্গে আলোচনা
মাসিক নিয়ে লজ্জা নয়, সচেতনতা জরুরি। তাই মেয়ের কাছের মানুষদের (পরিবার, স্কুল) সঙ্গে কথা বলুন, যেন তারা সহায়তা করতে পারে।
ছেলেদের সঙ্গে কথা বলুন
অনেক ছেলেই মাসিক সম্পর্কে কিছু জানে না বা মজা করে, যা মেয়েদের কষ্ট দেয়। তাই ভুল ধারণা ঠিক করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে এটি প্রাকৃতিক বিষয় এবং সহানুভূতির জায়গা তৈরি করতে হবে।
সূত্র: ইউনিসেফ
সম্পাদক ও প্রকাশক :
Copyright © 2025 বাংলার প্রভাতী. All rights reserved.