ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো কমপ্লেক্সে লাগা আগুন সাত ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে এসেছে। গতকাল শনিবার রাত ৯টা ১৮ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার কথা জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা খায়রুল ইসলাম রনি। তাছাড়া কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের কারণে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ৬ ঘণ্টা পর বিমানবন্দরে ফ্লাইট ওঠানামাও শুরু হয়েছে।
ফ্লাইট ছেড়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন এস এম রাগীব সামাদ।
শাহজালাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, রাত ৯টা ৬ মিনিটের পর থেকে আধা ঘণ্টায় তিনটি ফ্লাইট ছেড়ে গেছে। আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সগুলোকে ফ্লাইট অবতরণের জন্য বার্তা দেওয়া হয়েছে। ফ্লাইটগুলো নিরাপদে নামতে পারবে বলে জানানো হয়েছে।
রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত কয়েকটি ফ্লাইট নামতেও দেখা গেছে। তবে ফ্লাইট চলাচল শুরু হলেও বিমানবন্দরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে। তখনও বিমানবন্দরে ভিড় করে ছিলেন বিদেশগামী যাত্রীরা।
এদিকে, রাত ১০টায় ঘটনাস্থলে এসে বিফ্রিংয়ে ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মুহাম্মদ জাহেদ কামাল বলেন, আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আছে। বাড়ার আর আশঙ্কা নেই। আগুন নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে রানওয়ে প্রস্তুত করে ফ্লাইট চালু করার চেষ্টা করার কথাও বলেন তিনি। এদিন সোয়া ২টার দিকে কার্গো কমপ্লেক্সে আগুন লাগে, যা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ৩৫টি ইউনিট।
আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার তথ্য দেওয়া হলেও রাত ১২টা দিকে তা পুরোপুরি নেভেনি। সেখান থেকে ধোঁয়া বের হতে দেখা গেছে। আগুন নেভানোর চেষ্টার পাশাপাশি কার্গো ভিলেজের বাকি পণ্য যাতে নষ্ট না হয় সে চেষ্টা করছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর রানওয়ে প্রস্তুত হওয়ায় ফ্লাইট চলাচল শুরুর অনুমোদনও দেওয়া হয়েছে।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তিনটি ফ্লাইট ছেড়ে যাওয়ার তথ্য দিয়েছেন বিমানবন্দরের কর্মকর্তারা।
জানা গেছে, শাহজালাল বিমানবন্দরের আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের যে অংশে কুরিয়ারের কাজকর্ম চলে, গতকাল শনিবার বেলা সোয়া ২টার দিকে সেখানে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে কর্মীরা জানান। ফায়ার সার্ভিসের ৩৭টি ইউনিট সেখানে আগুন নেভাতে কাজ করে। সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ, আনসার, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী সদস্যরাও যোগ দেন অগ্নি নির্বাপণের কাজে। এই পরিস্থিতিতে দেশের প্রধান এই বিমানবন্দরে সব ধরনের ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ রাখা হয়। বেলা সাড়ে ৩টা থেকে সেখানে ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ থাকার তথ্য দেয় বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।
অভ্যন্তরীণ ও বিদেশ থেকে যেসব ফ্লাইট ঢাকায় নামার কথা, সেগুলোকে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দরে যেতে বলা হয়। ঢাকায় নামতে না পেরে অন্য বিমানবন্দরে চলে যায় এক ডজনের বেশি ফ্লাইট। ভয়াবহ এ আগুনের পর প্রথমে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের এয়ারফিল্ড গতকাল শনিবার সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বন্ধ রাখার কথা বলা হলেও পরে তা রাত ৯টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, শাহজালালে নামতে না পেরে আটটি ফ্লাইট চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। এর মধ্যে ইউএস বাংলা এয়ারলাইনসের ব্যাংকক থেকে ঢাকা এবং এয়ার অ্যারাবিয়ার শারজাহ থেকে ঢাকার দুটি ফ্লাইট রয়েছে।
বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সৈয়দপুর থেকে ঢাকাগামী ফ্লাইটটি ঢাকায় অবতরণ না করে চট্টগ্রামে অবতরণ করে।
একইভাবে ইউএসবাংলা এয়ারলাইন্সের চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী একটি ফ্লাইট উড্ডয়নের পর পুনরায় চট্টগ্রামে ফিরে যায। দিল্লি থেকে ঢাকার পথে থাকা ইন্ডিগো ফ্লাইট অবতরণ করে কলকাতায়।
ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুরগামী বাটিক এয়ারের ওডি১৬৩ ফ্লাইট এবং ঢাকা থেকে মুম্বাইগামী ইন্ডিগোর ৬ই১১১৬ ফ্লাইট ট্যাক্সিওয়েতে অপেক্ষা করে। হংকং থেকে ঢাকা আসা ক্যাথে প্যাসিফিক এয়ারলাইনসের বিমানটি অবতরণ না করতে পেরে অন্য বিমানবন্দরে যায়। সিলেট বিমানবন্দরে তিনটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট অবতরণ করে।
পরে রাত ৯টার দিকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় এক বার্তায় বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ড সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসার খবর দেয়। সেখানে বলা হয়, “ফায়ার সার্ভিস ও বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সমন্বয় করে নিশ্চিত করা যাচ্ছে যে আগুন সম্পূর্ণ নিভে গেছে। রাত ৯টা থেকে সব ফ্লাইট কার্যক্রম পুনরায় চালু করা হবে। “বিমানবন্দর ব্যবহারকারী যাত্রী ও সাধারণ জনগণের সহযোগিতা ও ধৈর্য ধারণের জন্য আমরা আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।”
মন্ত্রণালয় বলছে, ‘দ্রুত ও সমন্বিত পদক্ষেপে’ আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। এ ঘটনায় কোনো নিহতের ঘটনা ঘটেনি।
এরপর রাত ৯টা ৬ মিনিটে প্রথম ফ্লাইট ছেড়ে যাওয়ার তথ্য দেয় শাহজালাল কর্তৃপক্ষ। রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত কয়েকটি ফ্লাইট ওঠানামা করতে দেখা গেছে। এর আগে দুপুর ২টার আশেপাশে লাগা বিমানবন্দরে ইতিহাসের ভয়াবহ এই আগুন নিয়ন্ত্রণে একে একে যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিসের ৩৭ টি ইউনিট। সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষ, সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী সদস্যরাও যোগ দেন অগ্নি নির্বাপণের কাজে।
তবে কীভাবে সেখানে আগুন লেগেছে তা কর্তৃপক্ষ এখনও জানাতে পারেনি। সেখানে কর্তব্যরত অন্তত ২৫ জন আনসার সদস্য আহত হয়েছেন, যাদের সিএমএইচ ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বিমানবন্দরের পোস্ট অফিস ও হ্যাঙ্গারের মাঝামাঝি স্থানে কার্গো ভিলেজের যে অংশে আগুন লেগেছে সেখানে আমদানি করা পণ্য মজুত রাখা হয়। বিমানবন্দরের ৮ নম্বর গেটের পাশে আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। আগুন এতটাই ভয়াবহ যে শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কালো ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়।
কার্গো ভিলেজ এ মাথা থেকেও মাথা লম্বায আনুমানিক ৩০০ মিটার। বিমানবন্দরটির উত্তর-পূর্ব কোনায় এটি অবস্থিত। বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজের যেই অংশে কুরিয়ারের কাজকর্ম চলে সেখানে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্ট কর্মীরা। শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটির দিনে কার্গো ভিলেজের নিয়মিত কাজকর্ম বন্ধ থাকলেও কুরিয়ার শাখায় আধাবেলা পর্যন্ত কাজকর্ম চলে।
এয়ারপোর্ট কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি খায়রুল আলম ভুইয়া মিঠু বলছেন, ২টার দিকে তাদের লোকজন বের হয়ে যাওয়ার পরপর আগুনটা লাগে। সেখানে তখনো অনেক শ্রমিক, আনসারসহ লোকজন ছিল। কিন্তু আগুন লাগার পর আনসারসহ অন্যরা সবাইকে সরিয়ে দেন। তখন বলা হয়- এই গুদামে গোলাবারুদসহ কেমিকেল রয়েছে, ব্লাস্ট হতে পারে। সবাই সরে যান।
মিঠু অভিযোগ করেন, আগুন নেভাতে এসে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও ৮ নাম্বার গেটে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। অনুমতিজনিত জটিলতায় তারা ঢুকতে পারছিল না। বিমানের তিনজন কর্মী বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারা বলছেন, কুরিয়ার শাখা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। এরপর তারা দৌড় দিয়ে বের হয়ে আসেন।
ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ :
শুধু প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী হাজার কোটি টাকার মালামাল নষ্ট হয়নি, বরং তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য অপরিহার্য কাঁচামাল, রফতানির জন্য প্রস্তুত পোশাক এবং অসংখ্য উচ্চমূল্যের স্যাম্পল পণ্যও আগুনে পুড়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-এর জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি ইনামুল হক খান ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনের পর সাংবাদিকদের জানান, এই অগ্নিকাণ্ড অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। দেশের রফতানি বাণিজ্য, বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধ্বংস হওয়া মালামালের মধ্যে রয়েছে—উচ্চমূল্যের কাঁচামাল ও স্যাম্পল পণ্য, যা নতুন ব্যবসা ও আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এগুলো হারালে ভবিষ্যৎ ব্যবসায়িক সুযোগও বিপর্যস্ত হবে।
তিনি বলেন, “আমাদের সদস্যদের মধ্যে প্রতিদিন প্রায় ২০০-২৫০টি কারখানার পণ্য বিমানযোগে রফতানি করা হয়। তাই ক্ষতির পরিমাণ অনুপাতে অনেক বড় হতে পারে। আমরা ইতোমধ্যে সদস্যদের কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত পণ্যের তালিকা চেয়ে চিঠি পাঠিয়েছি এবং দ্রুত তথ্য সংগ্রহের জন্য অনলাইন পোর্টাল চালু করেছি।”
বিজিএমইএ’র পরিচালক ফয়সাল সামাদ বলেন, “আমরা ভেতরে গিয়ে ভয়াবহ অবস্থার মুখোমুখি হয়েছি। পুরো ইমপোর্ট সেকশন পুড়ে গেছে। প্রাথমিক অনুমান অনুযায়ী ক্ষতির পরিমাণ ১০০ কোটি টাকারও বেশি হতে পারে। তবে ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ নিরূপণ করতে কয়েক দিনের মধ্যে বিস্তারিত যাচাই করা প্রয়োজন।” তিনি আরও জানান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নতুন পণ্যের আমদানি কার্যক্রম দ্রুত শুরু করতে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন এবং আপাতত ৩ নম্বর টার্মিনালের নতুন স্থানে আমদানি পণ্য রাখার ব্যবস্থা করা হবে।
সম্পাদক ও প্রকাশক :
Copyright © 2025 বাংলার প্রভাতী. All rights reserved.