প্রভাতী ডেস্ক : জনগণের ভাষা বুঝে সময় থাকতে নিরাপদে ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, জনগণ এখন জেগে ওঠেছে। তারা আর এই অবৈধ লুটেরা সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। তাই আমি বলবো সময় থাকতে অবিলম্বে পদত্যাগ করুন। মানে ক্ষমতা ছেড়ে চলে যান। তা না হলে কিভাবে ক্ষমতা থেকে বিদায় দিতে হয় তা জনগণ জানে। অতীতে এধরণের অনেক নজীর রয়েছে। শনিবার(২৬ নভেম্বর) কুমিল্লার টাউনহল মাঠে অনুষ্ঠিত বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি একথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, প্রধানমন্ত্রী সরকারের সমস্ত সুযোগ সুবিধা ব্যবহার করে যশোরে সমাবেশ করেছেন। সেখানে তিনি জনগণের কাছে আবারো আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু জনগণ আর এই লুটেরা চোর সরকারকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না। দেশের মানুষ এখন পরিবর্তন চায়। সেই পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে আন্দোলন করতে হবে। আন্দোলনের মাধ্যমেই এই সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে হবে।
বিএনপি মহাসচিব নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগ, সংসদ বাতিল করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ছাড়া দেশে কোন নির্বাচন হবে না। আমাদের এই দাবি আদায় করতে হলে একাত্তর সালের মুক্তিযুদ্ধের মতো ঐক্যবদ্ধ হয়ে আরেকটি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের নেতা তারেক রহমান বলেছেন ‘ফয়সালার কোন পথ, রাজপথ রাজপথ’। তাই রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের ভোটের অধিকার আদায় করতে হবে। আমাদের দেশের হারিয়ে যাওয়া গণতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর এই অধিকার আদায়ের আন্দোলনে সবাইকে অংশগ্রহণের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান।
কুমিল্লা নামে বিভাগের প্রসঙ্গ তুলে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আপনারা কী কুমিল্লা নামে বিভাগ চান, নাকি মেঘনা বা গোমতী নামে বিভাগ চান। এ সরকার কুমিল্লার নাম বাদ দিয়ে অন্য নামে বিভাগ করতে চাচ্ছে। তবে আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে কুমিল্লার মানুষের প্রাণের দাবি অনুযায়ি কুমিল্লা নামে বিভাগ করা হবে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম তার ২৫ মিনিটের বক্তব্যে বলেন, রিজার্ভ এখন খালি হয়ে যাচ্ছে। আগামী তিন মাস আমদানি ব্যয় পরিশোধের টাকা নেই। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। গত ১০ বছরে ৮৬ লক্ষ কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। কুইক রেন্টালের নামে লুটপাট হয়েছে ৭৮ হাজার কোটি টাকা। অথচ এখন দেশের মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে না।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে দেশের মানুষের জীবন আজ দুর্বিষহ। চাল, ডাল, তেল, লবনসহ এমন কোন জিনিস নেই যার দাম বাড়েনি। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষের আয় তো বাড়েনি। তবে আয় বেড়েছে আওয়ামী লীগের নেতাদের। তারা ফুলে ফেঁপে ওঠেছে। যার একতলা ছিল, সে দশতলা বাড়ির মালিক হয়েছে। যার একটি গাড়ি ছিল সে এখন কয়েকটি গাড়ির মালিক। অথচ সাধারণ মানুষ আজ তার সন্তানের লেখাপড়ার খরচ চালাতে পারছে না। সন্তানের পাতে সপ্তাহে একদিনও একটি ডিম দিতে পারছে না। মানুষের পিঠ আজ দেয়ালে ঠেকে গেছে। এ অবস্থার পরিবর্তন চায় মানুষ। এই অবৈধ লুটেরা সরকারের হাত থেকে দেশের মানুষ আজ মুক্তি চায়। তাইতো মানুষ আজ রাজপথে নেমে এসেছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই সরকার দেশকে চরম বিপর্যয়ের পথে নিয়ে গেছে। আমরা ক্ষমতায় গেলে দেশকে মেরামতের চেষ্টা করবো। যারা এই সরকারের বিরুদ্ধে রাজপথে আমাদের সহযোদ্ধা হিসেবে থাকবেন তাদের সবাইকে নিয়ে আমরা জাতীয় সরকার গঠন করবো। এরপর বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের সকল পর্যায়ে আমরা পরিবর্তন করবো।
মির্জা ফখরুল বলেন, দেশের বিচার বিভাগকে এই সরকার ধ্বংস করে দিয়েছে। আজ আমরা ন্যায় বিচার পাই না। মিথ্যা মামলায় ফরমায়ি আদেশে আমাদের নেতাদের সাজা দিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে চায় এই সরকার। সেই লক্ষ্যে এই সরকার আবারও সেই পুরানো কৌশল অবলম্বন করেছে। সারা দেশে আবারও গায়েবি মামলা দেওয়া হচ্ছে। গত ১১ দিনে বিভিন্ন জায়গায় আমাদের নেতাকর্মীদের নামে ১০৪টি গায়েবি মামলা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন পত্রিকাতেও রিপোর্ট এসেছে, যেখানে শতশত ককটেল বিস্ফোরণের কথা বলা হয়েছে অথচ সেখানের মানুষ এর কোন আওয়াজই শুনতে পায়নি। এরকম ডাহা মিথ্যা গায়েবি মামলা দেয়া শুরু হয়েছে। শুধু তাই নয়, আমাদের আগামী ১০ ডিসেম্বরের ঢাকার মহাসমাবেশ যাতে সফল করতে না পারি এজন্য সরকার ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। তারা পরিবহন ধর্মঘট ডেকে নানাভাবে হয়রানি করে ইতিপূর্বে আমাদের সমাবেশে নেতাকর্মীদের আসার স্রোতকে থামাতে পারেনি। তাই এবার গায়েবি মামলা দিয়ে, ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে, আগুন সন্ত্রাসের উস্কানি দিয়ে ঢাকার মহাসেমাবেশকে বানচাল করতে চাচ্ছে। কিন্তু জনগণ আপনাদের এইসব হামলা মামলা ও হুমকি-ধমকিতে আর ভয় পায় না। জনগণ জেগে ওঠেছে। তাদেরকে আর দমানো যাবে না।
মহাসচিব বলেন, এই সরকার নিশি রাতের ভোট ডাকাতের অবৈধ সরকার। তারা আবারও নানা ছলে কৌশলে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চায়। কিন্তু আমরা স্পষ্ট করে বলতে চাই আপনাদের নীলনকশার নির্বাচন এদেশে আর হতে দেওয়া হবে না। ২০১৪ সালে মানুষ ভোট দিতে পারে নাই, ২০১৮ সালে দিনের ভোট রাতে হয়েছে। এবার আপনারা ইভিএম নামক যন্ত্রের মাধ্যমে জনগণের ভোটকে চুরি করতে চাচ্ছেন। কিন্তু ইভিএমে কোন ভোট এদেশে হবে না।
মির্জ ফখরুল বলেন, এই সরকার জনবিরোধী ফ্যাসিস্ট সরকার। অত্যাচার নির্যাতন চালিয়ে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি করে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের নয়নের কি অপরাধ ছিল? সমাবেশের প্রচারপত্র বিলি করতে গেলে তাকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। নয়নের বাবা এখানে বক্তব্য রেখেছেন। কিন্তু নয়নের বাবার চোখে আমি কোন অশ্রু দেখিনি, দেখেছি প্রতিশোধের আগুন, প্রতিরোধের আগুন। এই আগুন শুধু নয়নের বাবার চোখে নয়, এদেশের আপামর মানুষের চোখের আগুন। নয়নের বাবার মতোই গুম হয়ে যাওয়া দুই পিতার সন্তানেরাও এখানে বক্তব্য দিয়েছে। তারাও তাদের বাবাকে ফিরে পেতে চায়। তাদের এই আকুতি শেখ হাসিনার কর্ণে পৌঁছায় না। তবে জনগণ তাদের কথায় অবশ্যই রাজপথে নেমে আসছে। আর এই রাজপথের আন্দোলনে সরকারকে বিদায় নিতে হবে।
বিএনপি মহাসচিব দুঃখ করে বলেন, আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম একটি সুখি সমৃদ্ধ সুন্দর বাংলাদেশের জন্য। যেখানে মানুষ তার অধিকার পরিপূর্ণভাবে ভোগ করতে পারবে। কিন্তু হায়, স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও আমাদেরকে ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে, জীবন দিতে হচ্ছে। তবে অতীতে যেমন কোন আন্দোলন বৃথা যায়নি এবারও আমাদের এই আন্দোলন ব্যর্থ হবে না। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা আমাদের দাবি আদায় করবো ইন শা আল্লাহ।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ড.খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, এই সরকার গায়ের জোরের সরকার। বিনা ভোটের, রাতের ভোটের অবৈধ সরকার। এই সরকার গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে।
১৯৭৫ সালে বাকশাল কায়েমের মধ্যদিয়ে দেশের গণতন্ত্র হত্যা করেছিল, আর এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। লুটপাট করে দেশেকে দেউলিয়া করে ফেলেছে। জনগণ আর এই সরকারকে চায় না।
স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, হামলা মামলা দিয়ে আমাদের আন্দোলন ঠেকানো যাবে না। ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য মানুষ আজ রাজপথে নেমে এসেছে। সিন্দাবাদের ভূতের মতো আমাদের ঘাড়ে চেপে বসা এই সরকারকে বিদায় না করে ঘরে ফিরে যাবো না।
স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, এই বিশাল সমাবেশ সরকারের হৃদকম্পন বাড়িয়ে দিয়েছে। সরকার তাই আবোল তাবোল বকছে। হুমকি দিচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে। আমাদের নেতাকর্মীদের গুলি করে হত্যা করছে। কিন্তু তাতেও লাভ হচ্ছে না। জনগণ সব বাধা উপেক্ষা করে সমাবেশে আসছে। জনগণের এই আন্দোলনে সরকারকে বিদায় নিতে হবে।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু বলেন, এই সরকারের পতন ঘণ্টা বেজে গেছে। সমাবেশে যে জনস্রোতের সৃষ্টি হচ্ছে তাতে সরকারের পতন কেউ ঠেকাতে পারবে না। আগামী ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশ থেকে সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হবে। সেই আন্দোলনে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে।
ব্যারিষ্টার রুমিন ফারহানা এমপি বলেন, গত ১৪ বছর আমরা বিভৎস সময় পার করছি। গুম খুন লুটপাটে দেশ আজ চরম সঙ্কটের মধ্যে। এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের জন্য আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই। আমাদের সবাইকে রাজপথের আন্দোলনে থাকতে হবে।
কুমিল্লা জেলা (দক্ষিণ) বিএনপির আহ্বায়ক হাজী আমিন উর রশিদ ইয়াছিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনিরুল হক চৌধুরী, অধ্যাপক ড. সাহিদা রফিক, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনজুরুল আহসান মুন্সি, নির্বাহী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মারুফ হোসেন, মহিলা দলের সভাপতি আফরোজা আব্বাস, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হেলেন জেরিন খান, যুবদলের কেন্দ্রিয় সাধারণ সম্পাদক আবদুল মুনায়েম মুন্না, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি এসএম জিলানী, কৃষকদল নেতা হাসান জাকির তুহিন, ড্যাব নেতা ডা. হারুন আল রশিদ, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা আবদুর রহিম, কেন্দ্রিয় নির্বাহী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন শিশির, অ্যাডভোকেট জিয়াউদ্দিন জিয়া, অ্যাডভোকেট রফিক সিকদার, তদকির হোসেন জসিম। সমাবেশ পরিচালনা করেন কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব ইউসুফ মোল্লা টিপু ও কুমিল্লা (দক্ষিণ) জেলার সদস্য সচিব হাজী জসিম উদ্দিন।
মাঠে তিল ধারণের ঠাই নেই:
গতকাল সকাল ১০টার মধ্যেই আনুষ্ঠানিকভাবে সমাবেশ শুরু হয়। এসময় স্থানীয় নেতারা বক্তব্য দিতে থাকেন। সকাল ৯টা থেকে জেলার বিভিন্ন উপজেলা ও নগরীর ওয়ার্ডগুলো থেকে বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে মিছিল নিয়ে টাউন হল মাঠে আসতে থাকে। এসময় মাঠে প্রবেশ করার মতো জায়গা অবশিষ্ট ছিল না। আগের রাতেই মাঠ পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সকাল থেকেই মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় গোটা নগরী। বেলা ১২টা বাজার আগেই সমাবেশস্থল ছাড়িয়ে মানুষের ঢল নেমে আসে রাস্তায়। টাউনহল মাঠের আশপাশের জায়গা জনস্রোতে রূপ নেয়। কান্দিরপাড়, রামঘাট, নজরুল এভিনিউ, মনোহরপুর, জিলাস্কুল রোডসহ পুরো এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে।
সম্পাদক ও প্রকাশক :
Copyright © 2025 বাংলার প্রভাতী. All rights reserved.