প্রভাতী ডেস্ক : রাজধানীর উত্তরায় নির্মাণাধীন বিআরটি ফ্লাইওভারের গার্ডার চাপায় প্রাইভেটকারে থাকা শিশুসহ ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো ১জন। হতাহতদের নাম-পরিচয় তাৎক্ষণিক জানা সম্ভব হয়নি। সোমবার(১৫ আগষ্ট) বিকেলে উত্তরা জসীম উদ্দীন এলাকার আড়ংয়ের সামনে এ ঘটনা ঘটে।
এ বিষয়ে উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মোহসীন বলেন, বিকেলে নির্মাণাধীন বিআরটির একটি গার্ডার ক্রেন থেকে ছিটকে পড়ে যায়। এ সময় গার্ডাটি রাস্তার ওপর থাকা একটি প্রাইভেটকারের ওপর পড়ে। এতে করে প্রাইভেটকারে থাকা ৪জন যাত্রী ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন। এই ঘটনায় আহত হয়েছেন আরো দুই জন। তাদের উদ্ধার করে কাছের একটি হাসপাতালে পাঠানো হয়। এর মধ্যে ১জন সন্ধ্যায় মারা যান।
এদিকে গার্ডার পড়ে হতাহতের ঘটনা সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সোমবার সন্ধ্যায় সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিনুল্লাহ নূরী ঘটনাস্থলে পরিদর্শন শেষে ৩ সদস্যের এই কমিটি গঠনের কথা সাংবাদিকদের জানান। তিনি বলেন, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নীলিমা আক্তারকে প্রধান করে এই কমিটি গঠিত হয়েছে। কমিটিকে যতদ্রুত সম্ভব প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।”
ঘটনার পর থেকে ক্রেনের অপারেটর পলাতক রয়েছেন।
জানা যায়, প্রাইভেটকারে মোট ৭ জন আরোহী ছিলেন। দু’জনকে গুরুতর অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নিহতদের মধ্যে ২জন শিশু, ২ জন নারী এবং ১জন পুরুষ রয়েছেন। রাত ৮টায় প্রাইভেট কারের ভেতর থেকে নিহতদের লাশ উদ্ধার করা হয়। দুর্ঘটনায় নিহতরা হলেন- বর হৃদয়ের বাবা নুরুল ইসলাম রুবেল (৫০), কনে রিয়ার মা ফাহিমা (৪০), রিয়ার খালা ঝর্ণা (২৮), ঝর্ণার মেয়ে জান্নাত (৬) ও ছেলে জাকারিয়া (৩)। ঘটনাস্থলেই তাদের মৃত্যু হয়েছে। শুধু বেঁচে গেছেন নব দম্পতি হৃদয় ও রিয়া মনি ।
হৃদয়ের বাবা রুবেল হলেন ওই গাড়ির মালিক। পেশায় বাইং হাউজ ব্যবসায়ী। তিনি নিজেই গাড়িটি চালাচ্ছিলেন। ঘটনার পর স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে গোটা এলাকার আকাশ বাতাস। দীর্ঘক্ষণ যান চলাচল বন্ধ থাকায় তীব্র যানজট সৃষ্টি হয় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে।
প্রাইভেটকারে করে নবদম্পতি এবং দুই শিশুসহ ৭ জন রওনা দিলেও দুই পরিবারের ৮-১০ জন সদস্য বাসে করে রওনা দিয়েছিলেন। প্রাইভেট কারটি ছিল সামনে। আর বাসের যাত্রীরা ছিলেন পেছনে। বাসে থাকা রিয়া মনির নানা বৃদ্ধ রাশেদুল হক বাচ্চু বলেন, হঠাৎ আমার ছেলে ফোন করে বলেন, রিয়ামনিদের গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েছে। আমরা দ্রুত বাস থেকে নেমে প্রাইভেট কারের উদ্দেশে রওনা দিই। সেখানে গিয়ে আমাদের কিছুই করার ছিল না। দেখছিলাম, প্রাইভেটকার থেকে রক্ত ঝরে পড়ছে। কয়েকজন ধরাধরি করে দু’জনকে গাড়ির ভেতর থেকে বের করে। গাড়ির ভেতরে কয়েকজন আটকা পড়ে। তাদের বের করা যাচ্ছিল না। কিছুক্ষণ পর পুলিশ আসে। তাদেরও যে কিছু করার নেই। আর উৎসুক জনতা ছিল ছবি তোলা আর ভিডিও করা নিয়ে ব্যস্ত।
রিয়া মনির ভাই ফাহাদ বলেন, দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে আমরা প্রাইভেট কারের দরজা ধরে টানাটানি করছিলাম। কিন্তু গার্ডার পড়ে গাড়ি চ্যাপ্টা হয়ে পাওয়ায় দরজা খুলছিল না। বাইরে থেকে ডাকাডাকি করলেও ভেতর থেকে কোনো সাড়া পাচ্ছিলাম না। তখন বুঝতে পারি সবকিছু শেষ। ঘটনার তিন ঘণ্টা পর গার্ডার সরানো হয়। এরপর বের করা হয় সবার লাশ।
ঘটনাস্থলের পাশের একটি ভবনে রড মিস্ত্রীর সহযোগী ইমরান হোসেন ইমন সাংবাদিকদের বলেন, আমি দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। তখন দেখলাম গার্ডারটিকে ওপরে তোলা হয়েছে। এটাকে একটা বড় গাড়িতে তুলবে। রাস্তা খোলা ছিল, কাজও চলছিল। হঠাৎ বিকট শব্দে প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে গেল গার্ডারটি। প্রাইভেট কারের পেছনে একটি বাস ছিল, বাসটি দ্রুত ব্রেক কষে বামে সাইড করে ফেলে।
তিনি বলেন, এরপর আমরা ৫-৬ জন রড-শাবল নিয়ে এসে গার্ডার সরানোর চেষ্টা করি। এ সময় এক যুবক গাড়ির ভেতর থেকে বের হন। তার মাথা ফেটে গেছে। এরপর গাড়ির দরজা ভেঙে এক নারীকে উদ্ধার করি। তিনি বের হয়ে কান্নাকাটি করছিলেন। আমরা ভেতরে একটি শিশুকে দেখতে পেয়েছিলাম, শিশুটি বেঁচে ছিল। সে হাত-পা নাড়ছিল। কিন্তু গার্ডার সরাতে পারিনি বলে তাকে বাঁচাতে পারিনি।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, অবহেলাজনিত কারণে এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। যে গার্ডারটি প্রাইভেট কারের ওপর পড়েছে, সেটির ওজন ১৫০ টনের বেশি। আর যে ক্রেন দিয়ে গার্ডারটি সরানো হচ্ছিল সেটির ক্ষমতা ৮০ টন। কম ওজনের ক্রেন দিয়ে বেশি ওজনের গার্ডার সরানোর কারণেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
উক্ত ঘটনায় রাতে নিহত ফাহিমা আক্তার ও ঝরণা আক্তারের ভাই মো. আফরান মণ্ডল বাবু বাদী হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা দায়ের করেন।
উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মোহসীন মামলার বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
মামলায় ক্রেনের চালক, প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশন (সিজিজিসি) ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের অভিযুক্ত করা হয়েছে। ব্যক্তি হিসেবে আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতদের।
ওসি মোহাম্মদ মোহসীন জানান, ‘উত্তরায় ক্রেন দুর্ঘটনায় নিহত দুই বোনের ভাই বাদী হয়ে মামলা করেছেন। ঘটনাটি গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। জড়িত দোষীদের গ্রেফতারে পুলিশের অভিযান চলছে।’
সম্পাদক ও প্রকাশক :
Copyright © 2025 বাংলার প্রভাতী. All rights reserved.