
চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানাধীন পার্কভিউ হাসপাতাল থেকে প্রকাশ্যে এক যুবককে ছাত্রলীগ নেতা ট্যাগ দিয়ে তুলে নিয়ে ২০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়। পরে মারধর করে ১৬ ঘণ্টা আটকে রেখে একাধিক এটিএম বুথ থেকে ৬০ হাজার টাকা আদায়ের পর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় ওই যুবকের বাবা পাঁচলাইশ থানায় মামলা করলে ঘটনায় জড়িত ৩ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
অপহরণকারীরা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সঙ্গে যুক্ত বলে পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে। তবে পরবর্তীতে কেউ কেউ ‘আপ বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনের সঙ্গেও যুক্ত বলে জানা গেছে।
রবিবার (৯ নভেম্বর) রাত ৮টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। গ্রেফতারকৃতরা হলো- আশরাফুল আমিন (২৯), মো. তারিক আসিফ (২৭) ও শাহাদাত হোসেন শান্ত (২০)।
ওই যুবককে হাসপাতাল থেকে টেনেহিঁচড়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ভাইরাল হওয়া ১৪ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, সবার সামনে দিয়ে প্রকাশ্যে চার-পাঁচ জন তরুণ ওই যুবককে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন। তার দুই হাত দুই পাশ থেকে ধরে রেখেছেন তরুণরা।
তুলে নিয়ে যাওয়া যুবকের নাম ফয়সাল মাহমুদ (৩২)। তিনি কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা। বর্তমানে চট্টগ্রামে হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের মার্কেটিং অফিসার হিসেবে কর্মরত। এ ঘটনায় তার বাবা মো. জসিম উদ্দিন বাদী হয়ে পাঁচ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা চার-পাঁচ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। মামলার আসামিরা হলো- মোহাম্মদ আবুল সাজ্জাদ ওরফে আদর (৩২), আশরাফুল আমিন (২৯), মো. তারিক আসিফ (২৭), শাহাদাত হোসেন শান্ত (২০) ও আমিমুল এহসান ফাহিম (২৫)।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ফয়সাল মাহমুদ গত চার বছর ধরে চট্টগ্রাম শহরে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। গত রবিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ফয়সাল পাঁচলাইশ মডেল থানাধীন পার্কভিউ হাসপাতালে ডাক্তারের সঙ্গে ভিজিট করতে যান। রাত ৮টার দিকে হাসপাতালের ৪ তলায় ফয়সাল অবস্থানকালে আসামিরা ছাত্রলীগ ট্যাগ দিয়ে এলোপাতাড়ি কিলঘুষি, চড়-থাপ্পড় ও লাথি মেরে জোরপূর্বক তুলে একটি গাড়িতে করে নিয়ে যায়। তাকে অপহরণ করে রাউজান থানার গহিরা এলাকার একটি পরিত্যক্ত ভবনে নিয়ে আটকে রাখে। সেখানে তাকে মারধর করে শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম করে আসামিরা। সূত্র জানায়, অপহরণকারীদের ধারণা ছিল, ফয়সালের কাছে কুমিল্লার সাবেক সংসদ সদস্য ও প্রাক্তন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের এক হাজার কোটি টাকা রয়েছে। সেই গুজব থেকেই শুরুতে তারা ১০০ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। পরে অঙ্কটা কমে দাঁড়ায় ২০ লাখ টাকায়। টাকা না দিলে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়। তখন ফয়সাল অপহরণকারীদেরকে তার মানিব্যাগে থাকা দুই হাজার টাকা বের করে দেন।
মামলার এজাহারে আরও বলা হয়, অপহরণকারীরা তাদের দাবিকৃত টাকা না দিলে বড় ধরনের ক্ষতি করার হুমকি দেয়। সোমবার সকাল ৯টায় তারা ফয়সালকে ভয় দেখিয়ে রাউজান থানা এলাকার একটি ব্যাংকের বুথে নিয়ে আরো ১৮ হাজার টাকা তুলে নেয়। বেলা সাড়ে ১১টায় খুলশী থানাধীন জিইসি মোড়ে আরেক বুথে নিয়ে ৪০ হাজার টাকা তুলে নেয়। অপহরণকারীরা ফয়সালের কাছ থেকে সর্বমোট ৬০ হাজার টাকা আদায়ের পর প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে দুপুর ১২টার দিকে চকবাজার থানাধীন প্যারেড মাঠে রেখে যায়।
পুলিশ অনুসন্ধানে জানতে পারে, ফয়সাল মাহমুদ মনোহরগঞ্জ থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। তবে গত অন্তত চার বছর ধরে তিনি ওষুধ কোম্পানির মার্কেটিং সেলস অফিসার হিসেবে চট্টগ্রামে চাকরি করছিলেন। তিনি মূলত ক্যান্সার প্রতিরোধক ওষুধ বিপণন করেন।
ফয়সালের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন বিশ্লেষণ করে পুলিশ দেখতে পায়, তিনি ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংগঠন ও গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
এসব গ্রুপের মধ্যে রয়েছে— ‘হবো একদিন সবাই এক’, ‘ব্যাচ-১৩’, ‘জয় বাংলা’, ‘গোবিন্দপুর ছাত্রলীগ’, ‘লাকসাম মনোহরগঞ্জ আওয়ামী লীগ’, ‘বাইশগাঁও ইউনিয়ন ছাত্রলীগ’, ‘খিলা ইউনিয়ন ছাত্রলীগ’, ‘আশিয়াদারী ছাত্রলীগ’, ‘বাঁচতে হলে ঐক্যের বিকল্প নেই’, ‘আমরা সবাই মুজিব সেনা’, ‘একতাই শক্তি’, ‘৬৪ জেলা ইউনিট আওয়ামী লীগ’, ‘ধানমন্ডি–৩২’, ‘মৈশাতুয়া ইউনিয়ন ছাত্রলীগ’, ‘হাসনাবাদ ইউনিয়ন ছাত্রলীগ’, ‘ভাই ব্রাদার্স’, ‘মোস্ট পারসন’, ‘মানবতা আজ কোথায়’, ‘বীর মুজিব সেনারা’, ‘তৃণমূল ছাত্রলীগ কর্মী মনোহরগঞ্জ উপজেলা’, ‘যৌবনের প্রথম প্রেম বিএসএল’, ‘তৃণমূল কর্মী’, ‘ছাত্রসমাবেশ ঢাকা ১-৯-২৪’, ‘এ টিম’, ‘১৯৭১ ফ্রিডম বাংলাদেশ’ প্রভৃতি।
পুলিশের দাবি, এসব গ্রুপে ফয়সাল নিয়মিত লেখালেখি ও যোগাযোগ রাখতেন। ফলে ঘটনার ভিকটিম হলেও নিষিদ্ধ রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যক্রমে যুক্ত থাকার অভিযোগে তার বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সিএমপির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোলাইমান বলেন, ‘ছাত্রলীগ নেতা ট্যাগ দিয়ে হাসপাতাল থেকে ফয়সালকে অপহরণ করা হয়। পরে রাউজান উপজেলার একটি পরিত্যক্ত ভবনে নিয়ে আটকে রাখা হয়। সেখানে মারধর করে ভয়ভীতি দেখিয়ে ৬০ হাজার টাকা আদায় করা হয়। অপহরণকারীরা ২০ লাখ টাকা দাবি করেছিল। এ ঘটনায় ফয়সালের বাবা থানায় মামলা করলে ঘটনায় জড়িত ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। বাকিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।’









