মঙ্গলবার, ১১ই মার্চ ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

মঙ্গলবার, ১১ই মার্চ ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ মঙ্গলবার, ১১ই মার্চ ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৬শে ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ই রমজান ১৪৪৬ হিজরি

চটপটি বিক্রেতা থেকে চবি ছাত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকারের সদিচ্ছায় নাগরিকত্ব পাওয়া পরিবারের শিশু বৃষ্টি চবির ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাওয়াটা শুধু স্বপ্ন নয় দুঃস্বপ্নই বটে। জন্মের পর থেকেই বাবা মোহাম্মদ সাহাব উদ্দিনকে দেখে আসছেন অন্যের ভবনে নিরাপত্তা প্রহরীর দায়িত্ব পালন করতে। আর সেই ছোটবেলা থেকে মায়ের সাথে নিজেই চটপটি বিক্রি করতেন সংসারের বাড়তি কিছু আয়ের আশায়। ঘরের কাছেই সুবিধা বঞ্চিতদের জন্য ‘ওব্যাট প্রাইমারি স্কুল’ এর সামনে চটপটি বিক্রি করতে করতে ছোট্ট মেয়েটির মনেও পড়ালেখার প্রতি দুর্বলতা জমে। যা দেখে সেই স্কুলেই মেয়েকে ভর্তি করেদিলেন মা। স্কুলের সময়টুকু ছাড়া সেই বিদ্যালয়ের সামনেই চটপটি বিক্রি ছিল যার পেশা সেই সুলতানা আক্তার বৃষ্টি আজ স্কুল, কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় পা রাখার অপেক্ষায়। যে পরিবেশ থেকে তিনি উঠে আসার চেষ্টা করছেন সেখানে আজ এক অনুপ্রেরণার নাম বৃষ্টি।

আটকে পড়া পাকিস্তানিদের বসবাসের জন্য চট্টগ্রামে বেশকিছু স্থানকে সরকার চিহ্নিত করে দেয়। এরই একটি চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর বি-ব্লক ট্রেড স্কুল। এখানকার ছোট একটি ঝুপড়ি ঘরে বৃষ্টির জন্ম। মা-বাবা আর তাদের তিন বোনের সংসার। যেখানে রান্না সেখানে ঘুম। সেখানকার পরিবেশে ছোট্ট শিশুদের বেড়ে উঠার ন্যূনতম সুবিধাটুকুও নেই। অস্বাস্থ্যকর নোংরা পরিবেশে সারাক্ষণ প্রতিবেশীদের হই-হট্টগোল আর চিৎকার চেঁচামেচি।

সরকারের সদিচ্ছায় নাগরিকত্ব পেলেও দেশের মূল স্রোতে মিশতে পারছে না কোনোমতেই। তাতে মূল বাধাও এই শিক্ষা। বৃষ্টির পরিবারেও আগের প্রজন্মের কেউ শিক্ষার সাথে যুক্ত ছিলেন না। সেই হিসেবে বৃষ্টির হাত ধরেই তার পরিবারের দেশের মূলস্রোতে প্রবেশের প্রাথমিক পদক্ষেপ।

ট্রেড স্কুল ক্যাম্পে নিত্যদিনের চাহিদা মেটাতেই রীতিমতো সংগ্রাম করতে হয় এখানকার মানুষদের। খুন, রাহাজানি, মাদকে ছেয়ে আছে এখানকার পরিবেশ। বৃষ্টি যে পরিবেশ থেকে উঠে আসার চেষ্টা করছেন তা আসলেই বাস অনুপযোগী। সেখানে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়ার কথা চিন্তা করাও স্বপ্নের মতো। সেই পরিবেশেই কিছু মানুষের সহযোগিতা আর উৎসাহ ছাড়া পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া ছিল অসম্ভব। এঁদেরই একজন ওব্যাট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা সোহেল আকতার খান। ২০০৯ সালে বৃষ্টি ৫ম শ্রেণির সমাপনী দুই বিষয়ে ফেল করে যখন পড়ালেখাই ছেড়ে দিতে চাইছিলেন তখনই সোহেল আক্তার খানের উৎসাহে আবারও পরীক্ষা দিয়ে ‘এ’ পেয়ে উত্তীর্ণ হলেন।

ওব্যাট প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিকের পড়ালেখা শেষ করে মাধ্যমিকে ভর্তি হলেন স্থানীয় পি এইচ আমীন একাডেমি স্কুলে। সেই স্কুল থেকে বাণিজ্য বিভাগ থেকে জিপিএ-৪.৮৯ নিয়ে এসএসসি এবং সরকারি কমার্স কলেজ থেকে জিপিএ-৪.৭৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। এরপর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসা প্রশাসনে ভর্তি পরীক্ষায় অর্জন করলেন ৯১ দশমিক ৪৭ শতাংশ নম্বর।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেয়ে নিজের প্রতিক্রিয়ায় বৃষ্টি বলেন, ‘যে পরিবেশে মানুষ হয়েছি সেখানে পড়ালেখা করার জন্য উৎসাহ তো দূরের কথা, সবাই শুধু বলতো, এতো পড়ে কি হবে? সেই তো শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে হাঁড়ি ঠেলতে হবে। আসলে পড়ালেখার গুরুত্বটা এখানে অনেক সেভাবে ঠিক বোঝে না। তবে এখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পাওয়ার পর অনেকেই সচেতন হচ্ছে। সবাই প্রশংসা করছে। অন্যদের মধ্যে যদি এই অনুপ্রেরণাটা কাজ করে তাহলেই আমি অনেক খুশি হব। ’

ভবিষ্যত লক্ষ্য বিসিএস। তবে বিসিএস হোক বা না হোক মা-বাবাকে ভালো কোনো পরিবেশে নিয়ে যাওয়াই বৃষ্টির মূল লক্ষ্য। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাবা-মা আজীবনই কষ্ট করেছেন আমাদের জন্য। এখন সুযোগ পেলে আগে মা-বাবা ও বোনদের একটা ভালো পরিবেশ দিতে চাই। ’

Facebook
Twitter
LinkedIn
Telegram
WhatsApp
Email
Print